বাঙলায় মুসলিম রাজত্ব : ১২০৪ খ্রীস্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ বখতিয়ার খলজি বাঙলার তৃতীয় সেন নৃপতি লক্ষ্মণসেনকে সিংহাসনচ্যুত করে, বাঙলা অধিকার করেন ও বাঙলায় মুসলমান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময় ( ১২০৪ খ্রীস্টাব্দ) থেকে তুঘরল মুগীসুদ্দিন-এর সময় ( ১২৮২ খ্রীস্টাব্দ) পর্যন্ত মোট কুড়িজন সুলতান বাঙলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারপর ১২৮২ থেকে ১৩০১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে বলবন বংশীয় দুজন সুলতান বাঙলায় রাজত্ব করেন। এ দুজনের পর ১৩০১ থেকে ১৩২৭ পর্যন্ত বাঙলা ফিরোজশাহী বংশীয় পাঁচজন সুলতান কর্তৃক শাসিত হয়।
এর পর ১৩২৭ থেকে ১৩৩৮ পর্যন্ত মহম্মদ তুগলকের অধীন দুজন ও ১৩৩৮ থেকে ১৩৪২ পর্যন্ত মুবারক শাহী বংশের তিনজন সুলতান বাঙলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। এযাবৎকাল বাঙলার সুলতানগণ দিল্লীর সুলতানের অধীনস্থ হয়েই বাঙলাদেশ শাসন করছিলেন। এ ব্যতা প্রথম অঙ্গীকার করেন ফকরুদ্দিন মুবারক শাহ (১৩৩৮-১৩৪৯ খ্রীস্টাব্দ)। সুতরাং তাঁকেই বাঙলায় স্বাধীন সুলতানী আমলের উদ্বোধক বলা যায়। এই বংশের সুলতানগণ ১৪১২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বাঙলাদেশ শাসন করেন। তাঁরা সকলেই যোগ্য শাসক ছিলেন।
[ বাঙলায় মুসলিম রাজত্ব | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর ]
১৪১২ থেকে ১৪১৪ পর্যন্ত এই স্বল্পকালের মধ্যে বাঙলায় বায়াজিদ শাহী বংশীয় দু’জন সুলতান গৌড়ের সিংহাসনে অধিরূঢ় থাকেন। তারপর ১৪১৫ খ্রীস্টাব্দে রাজা গণেশ বা দমুজমর্দনদেব কয়েক বছরের জন্য গৌড়ে শ্বর হন। তারপর রাজা গণেশের পুত্র যদু ধর্মান্তরিত হয়ে জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহ নাম গ্রহণ করে ১৪৩৩ পর্যন্ত বাঙলাদেশ শাসন করেন। বোধ হয় এর মধ্যে রাজা গণেশের আর এক পুত্র মহেন্দ্রদেব ( ১৪১৮ খ্রীস্টাব্দ) সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
তারপর যথাক্রমে ১৪৩৬ থেকে ১৪৮৭ পর্যন্ত মাহমুদ শাহী বংশের, ১৪৮৭ থেকে ১৪৯৩ পর্যন্ত সুলতান শাহজাদা ও হাবশী সুলতানগণ ও ১৪৯৩ থেকে ১৫৩৮ পর্যন্ত হুসেন শাহী সুলতানগণ বাঙলাদেশ শাসন করেন। এ সময় বহিরাক্রমণের ফলে বাঙলাদেশে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ১৫৩৮ খ্রীস্টাব্দে বাঙলাদেশ মুঘলদের অধিকারে চলে যায়। কিছুদিনের জন্য সংঘর্ষ চলে, কিন্তু শেষপর্যন্ত বাঙলাদেশে মুঘল শাসনই প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫৭৬ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট আকবরের আমলে বাঙলাকে এক স্বতন্ত্র সুবায় পরিণত করা হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দশ-পনেরে| বৎসর পর্যন্ত বাঙলা মুঘল সুবেদারগণ কর্তৃক শাসিত হয়। এই সকল সুবেদারগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইসলাম খান, ইব্রাহিম খান ফতেজঙ্গ, রাজা মানসিংহ, সুলতান শাহ সুজা, মীরজুমলা, সায়েস্তা খান, আজিম-উশ-শান ও মুরশিদকুলি খান । ১৭১৬ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতি ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মুরশিদকুলি খান বাঙলায় স্বাধীন নবাবী আমলের সৃষ্টি করেন। নবাবরা ছিলেন সুজাউদ্দীন, সরফরাজ খান, আলিবর্দী খান ও সিরাজউদ্দৌলা। শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলা ইংরেজগণের হাতে পলাশীর যুদ্ধে ( ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দ) পরাজিত হন। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজরা দেওয়ানী লাভের পর কার্যত বাঙলায় মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে।
সাধ পাঁচশত বৎসর কাল বাঙলায় মুসলমান রাজত্ব ছিল। বিজেতা বখতিয়ার থিলজি (১২০৪ খ্রীস্টাব্দ) এক হাতে কোরাণ ও অপর হাতে অসি নিয়ে বাঙলায় প্রবেশ করেছিল। ধর্মীয় উন্মাদনার নেশায় মত্ত হয়ে মুসলমানরা গোড়া থেকেই হিন্দু ও বৌদ্ধদের মঠ-মন্দির-মূর্তি ভাঙা ও ধর্মান্তরকরণের অভিযান চালিয়েছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত তারা পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের কোন অঞ্চল জয় করতে পারেনি। গোড়ার দিকে বর্তমান দিনাজপুর জেলার দেবকোটই বাঙলায় মুসলমান শক্তির প্রধান কেন্দ্র ছিল। বহু হিন্দুকে তারা ধর্মান্তরিত করেছিল ও মঠ-মন্দির ভেঙে ফেলে তারই উপাদান দিয়ে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা ইত্যাদি নির্মাণ করেছিল।
এটা বখতিয়ার খিলজির আমল থেকেই শুরু হয়েছিল, এবং পরবর্তী অনেক সুলতানই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। নিরীহ দরিদ্র লোকদের ওপর তাদের অত্যাচার চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছেছিল। নারীধর্ষণ হামেশাই ঘটত। এটাই ছিল ধর্মান্তরিত করবার একটা প্রশস্ত রাস্তা, কেননা ধর্ষিতা নারীকে হিন্দুসমাজ আর স্থান দিত না। এভাবে হিন্দুসমাজ ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়েছিল। ক্ষীয়মাণ হিন্দুসমাজকে আসন্ন বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য স্মার্ত রঘুনন্দন বিধান দেন যে ধর্ষিতা নারীকে সামান্য প্রায়শ্চিতের পর পুনরায় হিন্দুসমাজে গ্রহণ করা চলবে।
পূর্ববঙ্গে অনেক দূর পর্যন্ত মুসলিম রাজত্ব বিস্তার করেন। তিনি ওড়িশাও আক্রমণ করেছিলেন। এ সময় ওড়িশার অন্তর্ভুক্ত ছিল মেদিনীপুর জেলার সমগ্র অংশ এবং বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও হুগলী জেলার অনেকাংশ। ওড়িশা জয় করা অবশ্য তুঘরলের উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ধনরত্ন ও হস্তী ইত্যাদি লুণ্ঠন করা।
চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শামসুদ্দিন ফিরোজশাহ একজন পরাক্রান্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন সুলতান ছিলেন। দীর্ঘ একুশ বৎসর ( ১৩০১-১৩২১ খ্রীস্টাব্দ) শাসনকালের মধ্যে তিনি সাতগাঁ, ময়মনসিংহ ও সোনারগাঁ, এমনকি সুদূর শ্রহট্ট পর্যন্ত তাঁর রাজাভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহের আমলে (১৩২৫-১৩২৮ খ্রীস্টাব্দ) লখনৌতি, সোনারগ ও সাতগাঁ বাঙলার সুলতানদের হস্তচ্যুত হয়, এবং ওই সময় সম্রাট মহম্মদ ভুগলকের অধীনস্থ শাসকরা লখনৌতি, সোনারগ ও সাতগাঁ অঞ্চলে শাসন করেন।
এই সময় ফকরুদ্দিন মুবারক শাহ (১৩২৮-১৩৪৯ খ্রীস্টাব্দ) সম্রাটের নিযুক্ত শাসকগণকে যুদ্ধে পরাহত করে সোনারগাঁ সমেত পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চল পুনরধিকার করেন ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত জয় করেন। এঁহট্ট জেলাও তাঁর রাজাভুক্ত হয়। তাকেই বাঙলার প্রথম স্বাধীন সুলতান বলা চলে। লোক হিসাবে তিনি ভাল হলেও হিন্দুদের ওপর তিনি খুব অত্যাচার করতেন। ফখরুদ্দিনের রাজত্ব কালেই মিশরের ইবন বতুতা বাঙলাদেশে এসেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে শ্রীহট্টের হিন্দুদের উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে দিতে হত। এ ছাড়া, আরও অনেক রকম করও দিতে হত।
স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে চতুর্থ সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহও (১৩৪২-১৩৫৮ খ্রীস্টাব্দ) হিন্দুদ্বেষী সুলতান ছিলেন। নেপাল আক্রমণ করে তিনি পশুপতিনাথের মূর্তি ত্রিথণ্ডিত করেন ও বহু নগর এবং মন্দির ধ্বংস করেন। ত্রিহুতের লোকদের ওপরও তিনি অত্যাচার ও লুঠতরাজ চালিয়ে ত্রিহুত অধিকার করেন। ওড়িশা আক্রমণ করেও তিনি বহু ধনরত্ন ও হস্তী লুণ্ঠন করেন। কামরূপের কিয়দংশ ও তিনি নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দর শাহ (১৩৫৮ ১৩৯০ খ্রীস্টাব্দ) আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লীর বাদশাহের কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকার করেন ও নিজেকে বাঙলা মুলুকের সার্বভৌম শাসনকর্তা হিসাবে ঘোষণা করেন। তিনিই প্রথম চীনদেশের সঙ্গে দূত ও উপঢৌকন বিনিময় প্রথা শুরু করেন।
সিকান্দর শাহের বিশিষ্ট কীর্তি পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজি নির্মাণ করা। ‘স্থাপত্যকৌশলের দিক দিয়ে এই মসজিদটি অতুলনীয়।’ কিন্তু এর নির্মাণে বহু হিন্দু মন্দিরের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল। তা থেকে সিকান্দার শাহের হিন্দুদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ পায়। পরবর্তী সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১০ খ্রীস্টাব্দ) অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, রসিক, কাব্যামোদী ও লোকরঞ্জক সুলতান ছিলেন। কিন্তু হিন্দুদের প্রতি তিনি ভ্রান্তনীতি অবলম্বন করেছিলেন। রাজ্যের উচ্চপদ থেকে তাঁদের অপসারণ করেছিলেন। যে সকল হিন্দু আমীরকে তিনি পদচ্যুত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজা গণেশ, যিনি খুব সম্ভবত গিয়াসুদ্দিনকে হত্যা করে বাঙলার সিংহাসন অধিকার করেন।
রাজা গণেশ ( ১৪১৫-১৪১৮ ) সম্বন্ধে সুখময় মুখোপাধ্যায় লিখেছেন—’রাজা গণেশ বাঙলার ইতিহাসের একজন অবিস্মরণীয়| পুরুষ। তিনিই একমাত্র হিন্দু যিনি বাঙলার পাঁচ শতাধিক বর্ষব্যাপী মুসলিম শাসনের মধ্যে কয়েক বৎসরের জন্য ব্যতিক্রম করিয়া হিন্দুশাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। অবস্থা গণেশের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই এই হিন্দু অভ্যুদয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও গণেশের কৃতিত্ব সম্বন্ধে সংশয়ের অবকাশ নাই। রাজা গণেশ খাঁটি বাঙালী ছিলেন, ইহাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। মুসলমানদের চক্ষে হিন্দু বিধর্মী।
একজন বিধর্মীর সিংহাসনে আরোহণ করায় রাজ্যের মুসলমানরা পীর, মোল্লা ও দরবেশদের নেতৃত্বে এক আন্দোলন শুরু করে দেয়। গণেশ কয়েকজন দরবেশ নেতাকে হত্যা করেন। মুসলমানরা তাতে আরও রুষ্ট হয়ে গণেশের উচ্ছেদ সাধনে কৃতসঙ্কল্প হয়। এই সুযোগে গণেশের পুত্র রাজনীতিচতুর যদু পিতৃপক্ষ ত্যাগ করে ও মুসলমান ধর্মগ্রহণ করে সিংহাসনে বসে। এর ফলে সাময়িক হিন্দুপ্রাধান্যের অবসান ও মুসলিম প্রাধান্য আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুদিন পরে রাজা গণেশ সুযোগ বুঝে আবার ফিরে আসেন ও নিজ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে বাঙলাদেশে পুনরায় হিন্দুর জয়পতাকা উড়িয়ে দেন। পুনরায় তিনি মোল্লা ও দরবেশদের দমন করতে থাকেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু ঘটে এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাঙলাদেশে হিন্দু আধিপত্যের পুনরুভ্যুদয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
তারপর গণেশের পুত্র যদু জালালুদ্দিন নাম গ্রহণ করে সিংহাসনে বসেন। তিনি অভ্যস্ত হিন্দুবিদ্বেষী সুলতান হয়ে দাঁড়ান। জোর করে তিনি হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতে থাকেন। অবশ্য বৃহস্পতিমিশ্র লিখিত সমসাময়িক ‘মৃতি রত্নাকর’ গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে রায় রাজ্যধর নামে একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু তার সেনাপতি পদে নিযুক্ত ছিলেন।
কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কিত পরিস্থিতির শীঘ্রই এক পরিবর্তন ঘটে। মাহমুদশাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান কুকমুদ্দিন বারবক শাহ (১৪৫৫-৭৬) নিজে তো পণ্ডিত ছিলেনই, পরন্তু হিন্দু ও মুসলমান অনেক কবি ও পণ্ডিতকে পৃষ্ঠ পোষকতা করতেন। যে সকল হিন্দুপণ্ডিত তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন বৃহস্পতিমিশ্র। সুলতান তাঁকে ‘পণ্ডিত সার্বভৌম’ ও ‘রায়মুকুট’ উপাধি দিয়েছিলেন। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর রচয়িতা মালাধর বসুও তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তাঁর অন্তরঙ্গ চিকিৎসক ছিলেন অনন্ত সেন। তাঁর মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন বৃহস্পতি রায়ের পুত্র বিশ্বাস রায়।
‘পুরাণসবঙ্গ’ গ্রন্থের সঙ্কলয়িতা গোবর্ধন ও তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। সুলতান তাঁকে ‘শুভরাজথান’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। তাঁর সভাসদ ও উচ্চ কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন কেদার রায়, নারায়ণ দাস, ভান্দসী রায়, জগদানন্দ রায়, ব্রাহ্মণ সুনন্দ, কেদার যাঁ, গন্ধর্ব রায়, তরণী, সুন্দর, শ্রীবৎস, মুকুন্দ প্রমুখেরা।
রুকনুদ্দিন বারবাক শাহের মৃত্যুর কয়েক বছর পরেই হাবশীরা (১৪৮৭ (১৪৯৩ বাঙলার সিংহাসন দখল করে বসে। হাবশীদের মধ্যে যারা প্রাধান্য লাভ করেছিল তারা হচ্ছে মালিক আন্দিল (ফিরোজশাহ), সিদি বদর (মুজাফর শাহ), হারশথান, কাফুর প্রভৃতি। কিন্তু শীঘ্রই হাবশী রাজত্বের অবসান ঘটে। পরবর্তী সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) সিংহাসনে আরোহণ করে হাবশীদের বাঙলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দেন। তিনিই বাঙলার শেষ বিখ্যাত সুলতান। তাঁরই সময়ে বাঙলায় চৈতন্যদেবের ১৪৮৫-১৫৩৩) আবির্ভাব ঘটে।
বাড়লায় বিদেশ বণিক পর্তুগীজদের আগমনও এই সময় ঘটে। যদিও ওড়িয়া ও বাংলার বৈষ্ণর সাহিত্যে বলা হয়েছে যে হুসেন শাহ ওড়িশা আক্রমণ করে বহু দেবমন্দির ও দেবমূর্তি ভেঙেছিলেন, তা হলেও আমরা জানি যে রূপ ও সনাতন নামে দুজন ব্রাহ্মণ হিন্দুই তাঁর প্রধান অমাত্য ছিলেন। আরও যেসব হিন্দু হুসেন শাহের আমলে উচ্চ রাজপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁরা হচ্ছেন বল্লভ ( রূপ ও সনাতনের ভাই ), শ্রীকান্ত (তাদের ভগ্নীপতি), চিরঞ্জীর সেন (গোবিন্দদাস কবিরাজের পিতা), পদকর্তা কবিশেষর, দামোদর ও যশোরাজ, বৈদ্য মুকুন্দ, ছত্রী কেশব খান প্রমুখ। হুসেন শাহ জ্ঞানীগুণী লোকদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর আমলে বাংলা সাহিত্য বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করেছিল। বিপ্রদাস পিপলাই, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, ঐকর নন্দী প্রমুখদের প্রাদুর্ভাব তাঁর আমলেই ঘটেছিল ।
হুিসেন শাহের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই বাঙলা মুঘল সম্রাটগণের করায়ত্ত হয়। এই ঘটনার অব্যবহিত পূর্বে বাঙলা কিছুকাল দূর ও কররানী বংশীয় আফগান নৃপতিদের অধীন ছিল। সুলেমান কররানীর ( ১৫৬৫ ১৫৭২) সেনাপতি কালাপাহাড় হিন্দুদের দেবমন্দির ও দেবমূর্তিসমূহ ধ্বংসের জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত। যদিও হুমায়ুনের আমলেই (১৫৫৩ খ্রীস্টাব্দে) গৌড় মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল, তা হলেও সম্রাট আকবরের সময় পর্যন্ত বিহার ও বাঙলায় আফগান আধিপতাই ছিল। আকবরই স্বয়ং এক বিশাল মুঘলবাহিনী নিয়ে বিহারে প্রবেশ করেন। তাঁরই অনুজ্ঞায় তোদড়মল্ল সেনাধ্যক্ষ খান জাহানকে সঙ্গে নিয়ে বাঙলা আক্রমণ করেন। এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ১৫৭৬ খ্রীস্টাব্দে আফ্ফান নৃপতি দায়ুদের পরাজয় ও নিধনের সঙ্গে বাঙলার ইতিহাসের আফগান যুগের সমাপ্তি ঘটে। এর পর বাঙলায় মুঘল শাসনের সূচনা হয়।
পাঠান আমলে রাজ্যশাসন ব্যবস্থা কিরূপ ছিল, সে সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করেই আমরা এ অধ্যায় শেষ করব। আমরা আগেই দেখেছি যে সুলতান ইলিয়াস শাহের সময় পর্যন্ত বাঙলার পাঠান সুলতানগণ দিল্লীর সুলতানগণেরই অধীন ছিলেন। সে সময় দেশশাসন ব্যবস্থা কিরূপ ছিল, তা আমরা সঠিক কিছু জানি না। তবে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সমগ্র রাজ্য যে কতগুলি অঞ্চল বা ‘ইক্তা’তে বিভক্ত ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রাজ্যের আমীরগণই বিভিন্ন ইক্তার শাসক নিযুক্ত হতেন। ইভার শাসককে ‘মোক্তা’ বলা হত। • সুলতানই বিভিন্ন ইক্তার শাসক নিযুক্ত করতেন।
সমগ্র রাজ্যের নাম ছিল ‘গৌড়’ বা ‘লখনৌতি’, কিন্তু পূর্ববঙ্গ যখন পাঠান সাম্রাজ্যভুক্ত হয়, তখন পূর্ববঙ্গকে ‘অরসহ বঙ্গালহ’ বলা হত। ১৩২৫ খ্রীস্টাব্দে সম্রাট মহম্মদ তুঘলক যখন বাঙলাদেশ সরাসরি নিজ অধিকারে রাখেন, তখন তিনি বাঙলাদেশকে তিনটি বিভাগে বিভক্ত করেন- লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও। বাঙলা যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তখন সমগ্র বাঙলার নাম ‘বঙ্গালহ’ হয়। সমগ্র রাজ্য তখন কতকগুলি ‘ইকলিম’-এ বিভক্ত হয়। ইকলিমের আবার কতকগুলি উপবিভাগ ছিল। সেগুলিকে বলা হত ‘অরসহ’। দুর্গহীন শহরকে বলা হত ‘কসবাহ’ ও দুর্গযুক্ত শহরকে ‘খিটটাহ’। সীমান্তরক্ষার ঘাঁটিগুলিকে বলা হত ‘থানা’
রাজধানীতে সুলতানের ছিল এক বিরাট প্রাসাদ। প্রাসাদের ভিতর অংশে থাকত ‘হারেম’ বা অন্তঃপুরবাসিনীদের বাসস্থান। বাইরের অংশে থাকত এক প্রশস্ত দরবার কক্ষ। সুলতান সেখানেই মন্ত্রী, সভাসদ, সচিব ও পদস্থ কর্মচারিগণ পরিবেষ্টিত হয়ে রাজকার্য সমাধা করতেন। অমাত্য, সভাসদ ও অভিজাতবংশীয় রাজপুরুষদের আমীর, মালিক ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হত। প্রধান মন্ত্রীকে বলা হত ‘ধান-ই-জহান’। সচিবদের ‘দবীর’ বলা হত। প্রধান সচিবকে বলা হত ‘দবার-ই-থান’। অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নাম ছিল ‘থান মজলিস’, ‘মজলিস-অল্ আলা’, ‘মজলিস-আজম’, ‘মজলিস-অল-মুআজ্জম’, ‘মজলিস-অল মজালিস’, ‘মজলিস-বারবক’ ইত্যাদি। এ ছাড়া, প্রাসাদের কর্মচারীদের নানা রকম নাম ছিল, যথা ‘হাজিব’, ‘সিলাহদার’, ‘শরাবদার’, ‘জমাদার’, ‘দরবান’ ইত্যাদি।
রাজকোষে দু’রকমের রাজস্ব জমা পড়ত—‘গনীমাহ’ বা লুঠের ধন ও ‘স্বরজ’ বা খাজনা। লুণ্ঠনলব্ধ অর্থের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ রাজকোষে জমা পড়ত, বাকিটা সৈন্যগণের মধ্যে বন্টিত হত। ‘খরজ’-এর জন্য এক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থসংগ্রহের শর্তে ভার দেওয়া হত বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির ওপর। রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারীকে বলা হত ‘সর-ই-ওমাশতাহ। নদীপথে যেসব পণ্য আসত, সে সবের ওপর শুল্ক যারা আদায় করত তাদের বলা হত ‘কুতঘাট’।
এছাড়া, আরও কর ছিল, যথা ‘হাটকর’, ‘ঘাটকর’, ‘পথকর’ ইত্যাদি। যারা মুসলমান নয় তাদের কাছ থেকে ‘জিজিয়া’ কর আদায় করা হত। আর কাজীদের কোন কর দিতে হত না। রাজ্যের সৈন্যবাহিনী চারভাগে বিভক্ত ছিল, যথা অশ্বারোহীবাহিনী, গঙ্গারোহীবাহিনী, পদাতিক ( বা পাইক) বাহিনী ও নৌবহর। বিভিন্ন বাহিনীর দলপতিদের নাম ছিল ‘সর-ই-খেল’।
নৌবহরের অধিনায়ককে বলা হত ‘মীর বহর’। যুদ্ধের অস্ত্র ছিল বর্শা, বল্লম, শূল প্রভৃতি। আর যুদ্ধ প্রধানত তীর-ধনুকের সাহায্যেই করা হত। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে কামানের ব্যবহার শুরু হয়। সেনাদলে বিস্তর হিন্দু থাকত। হিন্দু সেনাপতিও ছিল। ইলিয়াসের সেনাপতিদের মধ্যে ছিল শিখাই সান্যাল, সুবুদ্ধিরাম ভাছড়ি, কেশবরাম ভাছড়ি প্রভৃতি।
বিচারকদের কাজী বলা হত ইসলামিক বিধান অনুযায়ী তাঁরা বিচার করতেন। কোন কোন সময় সুলতান নিজেও বিচার করতেন। হিন্দুদেবতার নাম করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। রাজদ্রোহীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।
পাঠান সুলতানদের আমলে প্রভূত বৈষয়িক উন্নতি ঘটেছিল, বিশেষ করে স্থাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে। গৌড়, পাণ্ডুয়া ও মালদহকে কেন্দ্র করে তাঁরা অনেক রাস্তাঘাট, পুষ্করিণী, বাঁধ, সেতু, পরিখা, প্রাকার, দুর্গ প্রভৃতি নির্মাণ করে ছিলেন। বিশেষ করে তাঁরা প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন বহু মসজিদ, সমাধি সৌধ ও তোরণ নির্মাণের জন্য, যদিও এগুলির নির্মাণে বিধ্বস্ত হিন্দু ও বৌদ্ধ মঠ-মন্দির বিহারের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছিল।
গৌড় নগরে তাঁরা যেসব মসজিদ, সৌধ ও তোরণ নির্মাণ করেছিলেন, তার মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছে দখল দরজা বা গৌড় নগরের সিংহদ্বার, লুকোচুরি দরজা বা রাজপ্রাসাদের প্রবেশদ্বার, বাইশগজী প্রাচীর, কদম রসুল, চিকা মসজিদ, লোটন মসজিদ, ফিরোজশাহ মিনার, চামকাটি মসজিদ, তাঁতিপাড়া মসজিদ, গুণমস্ত মসজিদ, বড়সোনা মসজিদ, কোতয়ালী দরজা, রাজবিবি মসজিদ, বেগ মহম্মদ মসজিদ, পিঠাওয়ালী মসজিদ, আখি সিরাজের সমাধিসৌধ, ঝনঝনিয়া মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ, ফিরোজপুর দরজা, দরশবাড়ী মসজিদ, ফতে ইয়ার খাঁর কবর, ইত্যাদি।
পাণ্ডুয়াতেও তারা অনুরূপ অনেক সৌধ নির্মাণ করেছিলেন, যথা ছোট দরগা বা ভালেশ্বরী, সোনা মসজিদ, সিকন্দর শাহের কবর, সাতাশ ঘরা ইত্যাদি। গৌড় ও পাণ্ডুয়ার ন্যায় তাঁরা মালদহেও অনেক মসজিদ ও সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। পাঠান যুগের মসজিদ স্থাপতা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে স্থাপত্যের ক্ষেত্রে পাঠানরা ভারতে ‘গম্বুজ’ ও ‘মিনার’-এর কল্পনা প্রবর্তন করেছিলেন। মনে হয় এই মিনারের কল্পনা থেকেই পরবর্তীকালে ‘রত্ন’ মন্দিরের কল্পনা উদ্ভুত হয়েছিল।
আরও পড়ুন: