বাঙলার মনীষা ও সাহিত্যসাধনা | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর

বাঙলার মনীষা ও সাহিত্যসাধনা | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর : প্রাচীন বাঙলার মনীষা ও সাহিত্যসাধনা সম্বন্ধে এবার কিছু বলা যেতে পারে। বাঙালীর মাতৃভাষায় রচিত সাহিত্য খুব প্রাচীন নয়। সবচেয়ে পুরানো যে দাহিত্যের নিদর্শন আমরা পাই তা হচ্ছে ‘দোহা’ বা ‘চর্যাগীতি’। এগুলি খ্রীষ্টীয় প্রথম সহস্রকের শেষের দিকে রচিত হয়েছিল। তার পূর্বেকার সাহিত্য হয় সংস্কৃতে, আর তা নয়তো প্রাকৃত ভাষায় রচিত হত। বস্তুত ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ পৌছবার পূর্বেই বাঙলায় সংস্কৃত ভাষা প্রবেশ লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল।

বাঙলার মনীষা ও সাহিত্যসাধনা - চর্যাপদ পুঁথির একটি পৃষ্ঠা
চর্যাপদ পুঁথির একটি পৃষ্ঠা

এর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বণিক ও সাধুসন্তদের মারফত। সংস্কৃত ভাষায় অনুপ্রবেশের পূর্বে যে ভাষায় বাঙলাদেশের লোক কথাবার্তা বলত তা অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও আলূপীয় নরগোষ্ঠীর ভাষা। এদের মধ্যে আল্পীয় নরগোষ্ঠীর লোকরা আর্যভাষাভাষী ছিল। কিন্তু এই আর্যভাষার সঙ্গে বৈদিক আর্যগণের ভাষার কিছু প্রভেদ ছিল। ( ‘আর্য ও প্রাগার্য সভ্যতার সংশ্লেষণ অধ্যায় দেখুন)। পতঞ্জলি এটা লক্ষ্য করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, পূর্বভারতের লোকেরা কতকগুলি ‘ক্রিয়াশব্দ’ বিশেষ অর্থে এবং ‘র’ বর্ণটির পরিবর্তে ‘ল’ বর্ণ ব্যবহার করে।

পতঞ্জলি আরও বলেছিলেন যে, এরূপ ব্যবহার ‘অসুর’ জাতির উচ্চারণের বৈশিষ্ট্য। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ‘র’ স্থানে ‘ল’-এর উচ্চারণ মাগধী-প্রাক্বতেরও বৈশিষ্ট্য। এ থেকে মনে হয় যে, বাঙলার আদিভাষা মাগধী-প্রাকৃতেরই অনুরূপ কোন ভাষা ছিল। তবে বাঙলার সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন যা পাওয়া গিয়েছে তা হচ্ছে মহাস্থান থেকে প্রাপ্ত এক অনুশাসন। এই অম্ল শাসনের ভাষা মাগধী প্রাকৃতের অনুরূপ ভাষা।

[ বাঙলার মনীষা ও সাহিত্যসাধনা | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর ]

এই অনুশাসন খ্রীস্টপূর্ব কালের। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় রচিত এর পরবর্তী যে অনুশাসন পাওয়া গিয়েছে তা হচ্ছে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর। এটা হচ্ছে শুশুনিয়ায় প্রাপ্ত চন্দ্রবর্মণ রাজার গিরিলিপি। এর ভাষা সংস্কৃত হলেও মনে হয় সংস্কৃত ভাষা তখন বাঙলায় সবেমাত্র প্রবেশ করেছে, কেননা এই লিপিটি গদ্যে রচিত। পরবর্তী কালে বাঙালী যখন সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করে তখন স্থললিত ভাষায় কবিত্বপূর্ণ প্রশস্তি রচনা করতে শুরু করেছিল।

পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। উত্তর এবং পশ্চিম ভারত থেকে ব্রাহ্মণগণের বাঙলায় আগমনের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে সংস্কৃতচর্চার বিশেষ প্রাদুর্ভাব লক্ষিত হয়। এরূপ চর্চার জন্য যে কেবল ব্রাহ্মণরাই টোল স্থাপন করে ছিলেন তা নয়, বৌদ্ধদের বিহারগুলিও সংস্কৃত অধ্যয়ন ও অশ্বশীলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। অন্তত উয়াং চুয়াং যখন ভারতে এসেছিলেন তখন তিনি তাই দেখে ছিলেন। তিনি এবং অন্যান্য চৈনিক পরিব্রাজকরা বলে গেছেন যে, বৌদ্ধ বিহারগুলি সংস্কৃত ভাষায় মাত্র বৌদ্ধশাস্ত্রচর্চার কেন্দ্র ছিল তা নয়, দেখানে ব্যাকরণ, শব্দতত্ত্ব, ন্যায়, দর্শন, চিকিৎসা, বেদ, সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, ছন্দ-জ্ঞান, যোগ, জ্যোতিষ প্রভৃতি বিদ্যা সম্বন্ধে শিক্ষাদান করা হত।

রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত দূর্লভ চর্যাপদ এর অংশবিশেষ [ Rajshahi College Library Inside ]
রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত দূর্লভ চর্যাপদ এর অংশবিশেষ [ Rajshahi College Library Inside ]
খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যেই যে বাঙলায় সংস্কৃত ভাষা বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ আমরা পাই ওই সময়ের অনুশাসনগুলি থেকে। এগুলি সুললিত ছন্দে ও উপমাবহুল আলঙ্কারিক ভাষায় রচিত হয়েছিল। বিশেষ করে সংস্কৃত ব্যাকরণের চর্চা খুব উচ্চশীর্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কেননা সংস্কৃত ব্যাকরণের চান্দ্রশাথার প্রবর্তক চন্দ্রগোমিনের এই সময়েই আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁর গ্রন্থ থেকে ‘কাশিকা’ ৩৫টি সূত্র স্বীকার না করেই গ্রহণ করেছিলেন।

বস্তুত সংস্কৃত ব্যাকরণের চর্চা এ সময় বাঙলাদেশে খুব ব্যাপকভাবে হয়েছিল এবং অন্যান্য যে-সমস্ত বৈয়াকরণদের নাম আমরা অবগত হই তাঁরা হচ্ছেন জিনেন্দ্র বোধি গোবর্ধন, দামোদরসেন ও ইন্দুমিত্র। অভিধান রচনাতেও বাঙলাদেশের পণ্ডিতেরা বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। এই সকল পণ্ডিতদের মধ্যে সর্বানন্দ, পুরুষোত্তমদেব ও মহেশ্বরের নাম উল্লেখযোগ্য। চিকিৎসাশাস্ত্রে ও বাঙালী পণ্ডিতদের নাম সুদূর প্রসারিত হয়েছিল।

উয়াং চুয়াং বলে গিয়েছেন যে, চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। নিদান সম্বন্ধে এই যুগের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত ছিলেন চক্রপাণি দত্ত। তিনি ‘আয়ুর্বেদদীপিকা’ ও ‘ভানুমতী’ নামে যথাক্রমে চরক ও সুশ্রুতের ওপর টীকা রচনা করে গিয়েছেন। এ ছাড়া, তিনি আরও রচনা করেছিলেন ‘শব্দচন্দ্ৰিকা’, ‘দ্রব্যগুণসংগ্রহ’। এগুলি চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা সম্বন্ধে মৌলিক রচনা।

চণ্ডীদাস - প্রচার পুস্তিকা
চণ্ডীদাস – প্রচার পুস্তিকা

 

মারও যারা চিকিৎসাবিদ্যা সম্বন্ধে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন সুরেশ্বর বা শুরপাল ও বঙ্গদেন। সুরেশ্বর রচনা করেছিলেন ‘শব্দপ্রদীপ’, ‘বৃক্ষায়ুর্বেদ’ ও ‘লৌহ-পদ্ধতি’ এবং বঙ্গদেন রচনা করেছিলেন ‘চিকিৎসাসার সংগ্রহ’। উয়াৎ চুয়াং বলে গিয়েছেন যে, এ সকল গ্রন্থ তাল পাতায় লিখিত হত। রাজকীয় দপ্তরের বিবরণীসমূহও তালপাতায় লিখিত হত এবং সেগুলি বাঁধা হত নীল ফিতা দিয়ে। তবে এখানে বলা প্রয়োজন যে কাগজের ব্যবহারও খুব ব্যাপক ছিল।

বাঙলার পণ্ডিতগণ অন্যান্য যেসব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভা বিকশিত করে ছিলেন তাঁর অন্যতম ছিল জ্যোতিষ, দর্শন, কাব্য ও স্মৃতি। এই যুগের বাঙালী পণ্ডিতগণ এই সকল বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন। প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী মল্লিকার্জুন হুরী ‘শিষ্যধীমহাতন্ত্র’ নামে লন্নাচার্যের গ্রন্থের ওপর এক টীকা রচনা করেছিলেন। দার্শনিক শ্রীধরদাস ‘ন্যায়কন্দলি’, ‘অন্বয়সিদ্ধি’ ও ‘তত্ত্ববোধ সংগ্রহ’-এর টীকা রচনা করেছিলেন।

দর্শন বিষয়ে ভট্ট ভবদেবের ‘তৈতিতিত মালতিলক’ এবং হলায়ুধের ‘মীমাংসা-সর্বস্ব’ ও শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডন-খণ্ড-খাদ্য’ এই যুগেই রচিত হয়েছিল। স্মৃতির ক্ষেত্রে এই যুগের বড় স্মাতকার ছিলেন ভট্ট ভবদেব, মাধবভট্টের পুত্র গোবিন্দরাজ, ‘দায়ভাগ’-এর রচয়িতা জীমূতবাহন, অনিরুদ্ধ ভট্ট এবং ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’-এর রচয়িতা হলায়ুধ ও তাঁর দুই ভাই পশুপতি ও ঈশান। কাব্যের ক্ষেত্রে এযুগের বড় কবি ছিলেন ‘বেণীসংহার’-এর রচয়িতা ভট্রনারায়ণ, ‘রামচরিত’-এর রচয়িতা অভিনন্দ ও অপর সুপ্রসিদ্ধ ‘রামচরিত’ এর রচয়িতা সন্ধ্যাকর নন্দী।

রামচরিত মানস [ Ramcharit Manas ]
রামচরিত মানস [ Ramcharit Manas ]
বৈয়াকরণদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন ক্রমদীশ্বর। তিনি খ্যাতনামা হয়েছিলেন সংক্ষিপ্তসার ব্যাকরণ রচনা করে। বস্তুত পাল ও দেন-যুগকে আমরা বাঙলায় সংস্কৃত ভাষাচর্চার স্বর্ণযুগ নামে অভিহিত করতে পারি। যে সকল স্থানে নানা শাস্ত্র সম্বন্ধে অনুশীলন হত, তার অন্যতম ছিল তাম্র লিপ্তি ( মেদিনীপুর জেলায়), ভূরিশ্রেষ্ঠ (হুগলী জেলায়), সিদ্ধল (বীরভূম জেলায় ) ও বরেন্দ্রভূমের অন্তর্গত বনগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে ।

বৌদ্ধ গ্রন্থ রচনায় পাল সম্রাটগণের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। পালসম্রাট ধর্ম পালের পৃষ্ঠপোষকতায় হরিভদ্র রচনা করেছিলেন তাঁর ‘অভিসময়ালংকার’-এর বিখ্যাত টীকা। দ্বিতীয় গোপালের আমলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিক্রমশীলা বিহারে রচিত হয়েছিল ‘অষ্টদাহস্ৰিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা”। মহীপালদেবের আমলে ‘ওসমাজ’-এর অনেকগুলি টীকা প্রণীত হয়েছিল।

নয়পালদেবের আমলে রাজী উদ্দাকার ব্যয়ে রচিত হয়েছিল ‘পঞ্চৱক্ষা’ নামে একখানি গ্রন্থ। রামপালদেবের রাজত্বকালে অভয়াকর গুপ্ত কালচক্রযান সম্বন্ধে অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করে ছিলেন। তার মধ্যে যোগাবলী’, ‘মর্মকৌমুদী’, ও ‘বোধিপদ্ধতি’ প্রসিদ্ধ। রামপালদেবের রাজত্বকালেই নালন্দা বিহারে গ্রহকুও নামক জনৈক লেখক কর্তৃক ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ গ্রন্থটি অনুলিখিত হয়েছিল। তৃতীয় গোপালের রাজত্বকালে বিক্রমশীলা মহাবিহারে অনুরূপভাবে ‘অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা’র আর একখানি অনুলিপি সম্পাদিত হয়েছিল।

বিক্রমশীলা মহাবিহারের অন্যতম মহাস্তস্ত জ্ঞানশ্রীমিত্র (আনুমানিক একাদশ শতাব্দী ) রচনা করেন ‘কার্যকারণ ভারসিদ্ধি’, ‘ক্ষণভঙ্গাধ্যায়’, ‘আপোহ প্রকরণ’, ‘সাকার সিদ্ধিশাস্ত্র’ ইত্যাদি গ্রন্থ। উল্লেখনীয় যে রাজগীরের নিকট অবস্থিত নালন্দা ও পূর্ব-মগধে অবস্থিত বিক্রম নীলা বিহারদ্বয়ই এ যুগের বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুশীলন ও অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল। এগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাসম্পন্ন ছিল।

Dhameswar Mahaprabhu in Dhameswar Mahaprabhu temple
Dhameswar Mahaprabhu in Dhameswar Mahaprabhu temple

মোটকথা বিবিধ শাস্ত্র অনুশীলনের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণপণ্ডিতেরাই যে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন, তা নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৌদ্ধ পণ্ডিতদেরও বিশিষ্ট অবদান ছিল। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বজ্রযান-বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি বাঙলা দেশেই হয়েছিল। বলা হয়, উড্ডীয়ান বা ওখানের রাজা ইন্দ্রভৃতি (সম্ভবত সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দী ) ভগিনী বা কন্যার সহযোগে বাঙলায় ‘বজ্রযোগিনী সাধন’ প্রবর্তন করেন। বাঙলাদেশের বৌদ্ধদের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল জগদ্দল, সোমপুরী, পাণ্ডুভূমি, বিক্রমপুরী, দেবীকোট, সন্নগর, ফুল্লহরি, পণ্ডিতবিহার, পট্টিকেরক বিহার, শালবন বিহার, ত্রৈকূটক ও অন্যান্য স্থানে।

এই সকল বিহারের বৌদ্ধ ভ্রমণরা ধর্ম ও অন্যান্য বিষয়ে শত শত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সে সকল গ্রন্থের অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা তিব্বত, চীন ও মধ্য-এশিয়া থেকে মাত্র তাদের অনুবাদ পেয়েছি। ওই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন মহাচার্য দীপঙ্কর ( অপর নাম অভীশ)। অন্যান্য আরও যেসব পণ্ডিত ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন শীলভদ্র, শান্তিদেব, শান্তিরক্ষিত, জ্ঞানশ্রীমিত্র, অভয়ংকরগুপ্ত, দিবাকরচন্দ্র, দানশীল, কুমারবজ্র, বিভূতিচন্দ্র, বোধিভদ্র, প্রজ্ঞাবর্মা, মোক্ষকরগুপ্ত, পুণ্ডরীক, মৎস্যেন্দ্রনাথ ( লুই-পা), গোরক্ষনাথ, জালন্ধরীপাদ, বিরূপা, তিয়-পা, নব-পা, কাহ্ন-পা, দারিক, ‘কিল-পা, করমার, চীন-পা, গুণ্ডরীপাদ, কঙ্কণ ও গর্ভপাদ।

তারা হয় মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, আর তা নয়তো বিদ্যমান গ্রন্থের ওপর টীকা রচনা করেছিলেন। সংস্কৃত ও অপভ্রংশ— এই উভয় ভাষাতেই তাঁরা তাঁদের গ্রন্থসমূহ রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া, পালরাজাদের সময় বহু বৌদ্ধ ভিক্ষণীও মৌলিক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ রচনা করে যশস্বিনী হয়েছিলেন। তাঁদের রচিত গ্রন্থসমূহ তিব্বতী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। এই সকল বিদুষী বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের মধ্যে ছিলেন বিলাসবজ্রা, জ্ঞানডাকিনী নিও, লক্ষ্মীরা, লীলাবঞ্জ প্রমুখ।

শ্রীচৈতন্যের জীবন ও শিক্ষা [ Chaitanya's Life and Teachings ]
শ্রীচৈতন্যের জীবন ও শিক্ষা [ Chaitanya’s Life and Teachings ]
বাঙলায় সংস্কৃত চর্চার বিশেষ উৎকর্ষ ঘটেছিল তৃতীয় সেন নৃপতি লক্ষ্মণ সেনের (১১৭৯-১২০৮) আমলে। যে সকল সংস্কৃত কবি তাঁর সভা অলঙ্কৃত করতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন জয়দেব, ধোয়ী, শরণ, উমাপতি ধর প্রমুখ। জয়দেবই ছিলেন ভারতের শেষ শ্রেষ্ঠ সংস্কৃত কবি। তাঁর রচিত ‘গীতগোবিন্দ’ সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে এক অনবদ্য অবদান। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কেন্দুলির এক সুপ্রাচীন গোস্বামী-বংশে জয়দেবের জন্ম। পিতা ভোজদের ও মাতা বামাদেবী দুজনেই ছিলেন পরম ধার্মিক। বহুদিন তাঁদের ছেলেপুলে হয়নি। তারপর দেবতার কাছে সন্তান প্রার্থনা করায়, দেবতা তাঁদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এক শ্রীপঞ্চমীর পুণ্যতিথিতে জয়দেবের জন্ম হয়।

শৈশবেই জয়দেব সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। যথাসময়ে জয়দেবের উপনয়ন হয়। উপনয়নের পর জয়দেবের মনে বৈরাগ্যের উদয় হয়। একদিন গৃহত্যাগ করে তিনি জগন্নাথক্ষেত্রের দিকে যাত্রা করেন। এক্ষেত্রে পৌঁছে দেবাদিদেব জগন্নাথের চরণে নিজেকে নিবেদিত করেন ও তাঁরই ধ্যানে তন্ময় হয়ে থাকেন। এখানে তিনি মাধবাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মাধবাচার্য তাঁকে ব্যাকরণ, ছন্দ ও শাস্ত্র সম্বন্ধে শিক্ষাদান করেন। তারপর জয়দেব আশ্রয় নেন মন্দিরের বাইরে এক গাছতলায়।

সকাল-সন্ধ্যায় সমুদ্রে স্নান করে এসে ইষ্টদেবতার আরাধনা করেন, আর তাঁর সামনে নিজের রচিত বন্দনা-গীতি গান৷ বৈষ্ণবের ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করেন, তাতেই মুখে দিন কাটাতে থাকেন। তাঁর অনেক শিষ্য জুটে যায়, তার মধ্যে ছিল সুগায়ক পরাশর।

তথন তাঁর ষোল বছর বয়স। একদিন সন্ধ্যা আরতির সময় মন্দিরে এসে উপস্থিত হন এক ব্রাহ্মণ ও তার রূপসী কন্ঠ।। মেয়েটি এসেছে নববধূবেশে স্কুলের মালা হাতে করে, নিজেকে জগন্নাথের সেবার সমর্পণ করবার জন্য। আগন্তুক ব্রাহ্মণ বাঙালী, নাম বাহুদেব ভট্টাচার্য, নিবাস নদীয়ার নবগ্রামে। বহুদিন নিঃসন্তান ছিলেন। জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে যদি তার সন্তান হয়, তাকে সমর্পণ করবেন জগন্নাথের সেবায়। সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্যই আজ তিনি এসেছেন জগন্নাথের মন্দিরে।

মেয়েটির নাম পদ্মাবতী। ঠাকুরের সামনে গিয়ে পিতা ও কন্যা পদ্মাবতী দাড়িয়েছেন। ঠাকুরকে প্রণাম করছেন। পিতা বাসুদের প্রত্যাদেশ শুনলেন ‘আমি আমার মানসকন্যা পদ্মাবতীকে গ্রহণ করলাম। কিন্তু তুমি একে নিয়ে মন্দিরের বাইরে যাও। সেখানে আমার পরম ভক্ত জয়দেব আমার ধ্যানে বিভোর হয়ে আছে। তার হাতে তুমি তোমার কন্যাকে সমর্পণ কর।

Anthropology Gurukul Logo

বাইরে এসে গরুড়ধ্বজের সামনে দেখতে পেলেন দিব্যকান্তি জয়দেবকে ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছেন। ধ্যান ভঙ্গ হলে, বাসুদেব জয়দেবকে বললেন ঠাকুরের প্রত্যাদেশের কথা। জয়দেব বললেন, ‘আমি ঠাকুরের এ আদেশ রক্ষা করতে পারব না।’ ব্রাহ্মণ যখন জয়দেবকে এ-বিষয়ে অচল অটল দেখলেন, তখন তিনি পদ্মাবতীকে তাঁর সামনে রেখে সরে পড়লেন। জয়দেব সংজ্ঞা হারালেন।

গভীর রাত্রে যখন তাঁর সংজ্ঞা ফিরে এল, জয়দেব তখন দেখলেন যে পদ্মা বর্তী যুক্তকরে তাঁর সামনে বসে আছে। জয়দেব তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন —’তুমি গেলে না যে! মেয়েটি উত্তরে বলল – “আমার বাবা যে আপনার হাতে আমাকে সম্প্রদান করে গেলেন। দেবতার আদেশ ও পিতার নির্দেশ অবহেলা করে, আমি তো আপনাকে ত্যাগ করতে পারব না।’

জয়দেছ অগত্যা বাধ্য হলেন পদ্মাবতীকে গ্রহণ করতে। সেই থেকে স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলে তাঁদের ভক্তি ও প্রেম দিয়ে জগন্নাথের আরাধনায় নিজেদের নিযুক্ত রাখলেন। পুরীর রাজা আনন্দদের মাঝে মাঝে মন্দিরে এসে জয়দেবের গান শুনতেন ও পদ্মাবতীর আরতি দেখতেন।

এরপর পিতামাতার জন্য জয়দেবের মন উতলা হয়ে ওঠে। কেন্দুলিতে তিনি আবার ফিরে আসেন। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন রাধামাধবের বিগ্রহ। তাঁর চরণে নিবেদন করেন জয়দেব নিজেকে ও পদ্মাবতীকে। জয়দেবের গানে এবং পদ্মা বতীর নৃত্যে মুখরিত হয় কেন্দুলির আকাশ-বাতাস। তাঁর কবিত্ব ও পাণ্ডিত্য মুগ্ধ করে সমগ্র জগতকে। রাজা লক্ষ্মণসেন সাদরে নিয়ে গেলেন তাকে নিজের রাজসভায় সভাকবি হিসাবে।

গীতগোবিন্দম্‌ পাণ্ডুলিপি খ্রিস্টীয় ১৬শ শতাব্দী
গীতগোবিন্দম্‌ পাণ্ডুলিপি খ্রিস্টীয় ১৬শ শতাব্দী

জয়দেব রচনা করতে লাগলেন তাঁর অমর গীতিকাব্য ‘গীতগোবিন্দ’ । যে দিন যে সঙ্গীতটি রচিত হয়, স্বামী-স্ত্রীতে সুধাময় কণ্ঠের সুর-তান-লয়ে ও হৃদয়ের প্রগাঢ় ভক্তির সঙ্গে ইষ্টদেবতা শ্রীরাধামাধবের চরণতলে সমর্পণ করে তবে সাধারণে প্রকাশ করেন।

একদিন কবি লিখেছেন—’ওগো প্রিয়ে, তোমার কুরুকুত্তের উপরে যে মণিহার দুলছে, তার দীপ্তিতে তোমার বুক আলোকিত হয়ে উঠুক। তোমার সঘন-জয়নের মেথলা রতিরঙ্গে মুখরিত হয়ে মন্মথের জয়বার্তা ঘোষণা করুক। স্থল-কমল গঞ্জন আমার হৃদয়রঞ্জন ওগো প্রিয়ে, তুমি আদেশ কর রতিরঙ্গে সুশোভিত তোমার ওই রক্তচরণখানি আমি অলক্তকরাগে রঞ্জিত করি। মদনের দহনজালায় আমার সর্বাঙ্গ জলে যাচ্ছে। অতএব হে প্রিয়ে—’স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসি মশুনম।” কবি থেমে গেলেন, আর লিখতে পারলেন না। পরমপ্রকৃতি রাধিকার পদযুগলকে তিনি শিরোভূষণ করতে চান। কিন্তু বিশ্ব যার চরণাশ্রিত সেই শ্রীকৃষ্ণ নিজে কি করে শিরে রাধিকার চরণ স্থাপন করবেন? চিন্তিত মনে জয়দেব গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে গেলেন। পুঁথি খোলা পড়ে রইল।

কিছুক্ষণ পরে জয়দেব আবার ফিরে এলেন। পদ্মাবতীকে বললেন- আজ আর গঙ্গায় গেলাম না, অজয়ের জলেই স্নানটা সেরে ফেললাম। এই কথা বলে তিনি ঘরে ঢুকে পুঁথিটায় কি লিখলেন। তারপর আহার শেষ করলেন। পদ্মাবতী পদসেবা করে তাঁর ভুক্তাবশেষ অন্নভোজনে নিযুক্ত হল। এমন সময় স্নান সেরে জয়দেব বাড়ি ফিরলেন। জয়দেবু আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, যে পদ্মাবতী তাঁর ভুক্তাবশেষ ছাড়া খায় না, সে আজ তাঁর আগেই খেতে বসেছে।

এদিকে, পদ্মাবতী ও স্বামীকে আবার ফিরতে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। পরস্পর পরস্পরের কথা শুনে সংশয়াচ্ছন্ন হলেন। ঘরে গিয়ে দেখেন তাঁর অসমাপ্ত পাদপূরণ হয়ে গিয়েছে। লেখা রয়েছে—‘দেহি পদপল্লবমুদারম্’। বুঝতে কারুর বাকী রইল না যে, তাঁদের প্রাণের ঠাকুর নিজে এসেই লিখে দিয়ে গেছেন—’দেহি পদপল্লব মুদারম্।’ জয়দেব বললেন –

পদ্মা, তুমিই ধন্যা, তুমিই সৌভাগ্যবতী, তোমার স্বামীর রূপ ধরে পরমপুরুষ আজ তোমাকে দেখা দিয়ে গিয়েছেন। আর তুমি তাঁর পদসেবা করবার দৌভাগ্য লাভ করেছ। আমিই অভাজন, তাই তাঁকে দর্শন করতে পারলাম না।

এর কিছুদিন পরে সাধক-দম্পতি তাঁদের প্রাণের ঠাকুর রাধামাধবকে নিয়ে বৃন্দাবন যান। ‘ধীরসমীরে যমুনাতীরে তাঁরা তাঁদের বসতি স্থাপন করেন। জয়দেব ও পদ্মাবতীর কণ্ঠে গীতগোবিন্দ কীর্তন বৃন্দাবনের আকাশ-বাতাস মাতিয়ে তুলগ।

তারপর একদিন তাঁর প্রাণের ঠাকুরের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলেন জয়দেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভক্তের প্রাণবায়ু ভগবানের প্রাণবায়ুর সঙ্গে মিশে গেল। স্বামীকে অনুসরণ করে পদ্মাবতীও অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলেন রাধারানীর দিকে। তাঁর প্রাণবায়ুও পরমা প্রকৃতির প্রাণবায়ুর সঙ্গে মিশে গেল।

জয়দেবের মৃত্যুর পর তাঁর পূজিত রাধামাধব মূর্তিটি বহুদিন কেশীঘাটের মন্দিরে অবস্থিত ছিল। মন্দিরটি জীর্ণ হলে ‘শ্রচৈতন্যচরিতামৃত’-এর রচয়িতা শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ ভ্রমরঘাটের ওপর নূতন রাধামাধব মন্দির নির্মাণ করে দেন। হিন্দুদ্বেষী ঔরঙ্গজেব যখন হিন্দুর মন্দির ও দেবদেবীর ধ্বংসলীলায় মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, তখন জয়পুরের মহারাজা বৃন্দাবনের অন্যান্য বিগ্রহের সঙ্গে রাধামাধবকে জয়পুরে নিয়ে যান। জয়দেবের রাধামাধব এখনও সেখানে বিরাজ করছেন। বৃন্দাবনে এখন মাত্র প্রতিনিধি বিগ্রহ আছে। (কেন্দুলির বিগ্রহ ও মন্দির সম্বন্ধে ‘ধর্মীয় চেতনার প্রকাশ’ অধ্যায় দেখুন)।

বাঙলাদেশে রচিত হিন্দু যুগের সংস্কৃত সাহিত্য সম্বন্ধে অনেক কথাই বলা হল। এবার ওই যুগের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু বলা যাক। ওই যুগের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরানো নিদর্শন হচ্ছে ‘চর্যাগীতি’ বা চর্যাগান। এগুলি বৌদ্ধ সহজিয়াপন্থীদের সাধন-ভজনের গান। এগুলি আবিষ্কার করেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে। তিনি চারখানা পুঁথি প্রকাশ করেছিলেন। এগুলির নাম হচ্ছে—’চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, সরোহবজ্রের ‘দোহাগান’, কাহ্ন-পাদের ‘দোহাকোষ’ ও ‘ডাকার্ণব’। কারও কারও মতে ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ পুঁথিখানির যথার্থ নাম ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়’।

পুঁথিগুলির ভাষা যে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম রূপ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে সূক্ষ্ম বিচারে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় একে ‘অবহট্ট’ ভাষা বলেছেন। পুঁথির গানগুলিতে এমন অনেক শব্দ আছে যা বর্তমান কালেও বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে। যেমন— ‘জান’, ‘নিল’, ‘গেল’, ‘রাতি’, ‘দুই’, ‘ঘরে’, ‘করি’, ‘বিশ্ব’, ‘মাঝে’, ‘চড়িলে,’ ‘ছাড়ি’, ইত্যাদি। গানগুলি ‘সন্ধাভাষায় রচিত বলা হয়। তারাপদ মুখোপাধ্যায় মহাশয় বলেন, সন্ধাভাষা কোন ভাষার নাম নয়। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের সংস্কৃত-অবহট্ট-বাংলা রচনায় অবলম্বিত বিশিষ্ট রীতির নাম ‘সন্ধা’। এই রীতিতে শব্দের বাচ্যার্থের এক অর্থ, গুহার্থের আর এক অর্থ। শব্দের গুহার্থের সাহায্যে সাধকেরা সাধন-পদ্ধতির নিগূঢ় কথা ব্যক্ত করেছেন।

চর্যাগানগুলিতে ব্যবহৃত রূপক প্রতিভাসের ভিতর দিয়ে তদানীন্তন বাঙালী জনজীবনের যে নিখুঁত ছবি ফুটে উঠেছে তার একটা পরিচয় দিয়েছেন জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘বঙ্গের সামাজিক ইতিহাসের নানা উপকরণ এতে ছড়ানো রয়েছে। অষ্টম-নবম শতাব্দের তাম্রপট্টলিপিতে সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’-এ এদেশের প্রাচীন ইতিহাসের যে উপাদান পাওয়া যায়, চর্যাগানের ঐতিহাসিক চিত্রের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে। সেজন্য মনে করা হয় যে, চর্যা গানগুলির উদ্ভব ওই যুগেই ঘটেছিল। উপরন্তু চর্যাগীতিতে আছে নতুনতর উপকরণ।

চর্যাগীতিতে আমরা যে সমাজ-গড়নের পরিচয় পাই, তা হিন্দু ব্রাহ্মণ্যসমাজেরই গড়ন। সে সমাজের উচ্চকোটিতে রয়েছেন বটুব্রাহ্মণ; নিম্ন কোটিতে ডোম-চণ্ডাল, মধ্যে উত্তম ও অধম শূদ্র। আর বর্ণসমাজ থেকে দূরে রয়েছে অরণ্যবাসী শবর-নিষাদ। তবু চর্যায় ব্রাহ্মণ অপেক্ষ। নানা প্রসঙ্গে নিম্ন শ্রেণীর কথাই প্রাধান্ত লাভ করেছে।

চর্যাগীতি কর্মবহুল সাধারণ জীবনের বিচিত্র চিত্রশালা। চর্যাগানে যে অভিজাত বা ঐশ্বর্যবান মানুষের প্রসঙ্গ নেই, তা নয়। দেশে ধনবান লোক ছিলেন, তাঁরা কেউ ছিলেন পঞ্চপাটনের মালিক, কারও সঞ্চয় চতুষ্কোটি মুদ্রার ভাণ্ডার—সোনারূপার সঞ্চয় ত ছিলই। কিন্তু সময়ে সময়ে দস্যুরা এমন ধনীকে নিঃস্ব করে ফেলত।…চর্যাগীতিতে হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে সাধারণ জীবনেরই ছবি। সে জীবন সুখে-দুঃখে, আশা-নিরাশায় করুণ মধুর। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, বধূ নিয়ে বাঙালীর যৌথ পরিবার। কখনও পরিবারে শ্যালিকারও স্থানও হত। কার্পাসবস্ত্র পরে, মোটা ভাত খেয়ে জীবন মোটামুটি সুখেই কাটত। কিন্তু দুঃখের বোঝাও বাঙালীকে বইতে হত। একটি গীতে বলা হয়েছে ‘স্থাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী’। এ দুঃখের হাহাকার বুঝি অভাবপীড়িত বাঙালী জীবনের একটি অতি সাধারণ মর্মান্তিক স্থর।

চর্যা গানে এই দুঃখ-গভীর নারী চায় ঘরমুখী স্বামী, ঘরমুখী সন্তান। কিন্তু যা সে চায় তা সে পায় না। স্বামী হয় বেকার উদাসীন, সন্তান হয় ‘বায়ুরা’ (বাউল)। এ দুঃখের কী শেষ আছে? তখন গভীর দুঃখেই শ্লেষকঠিন হয় কণ্ঠ— আমার নব যৌবন সার্থক হল— ‘নব জৌবন মোর ভইলেরি পুরা। তবে নারীচরিত্র সর্বত্র সাব্বীর চরিত্র হত না। বধূর শীলখণ্ডন ঘটত। কেউ বাইরের উঠানকেই ঘর মনে করত। দিনের বেলায় যে বৌ নিজের দেহছায়া দেখে ভয় পেত, রাত্রিতে তার কামরূপে অভিসার—’দিবসই বহুড়ী কাড়ই ডরে ভাঅ। রাত্রি ভইলে কামরু জাম। পুরুষচরিত্রও হুস্থির ছিল না।

পরকীয়া নারীর অধরামৃত পুরুষভুজঙ্গের পক্ষে কমল-রস। আর একটি ঘটনাও গৃহ-জীবনে ঘটত—তা গৃহবন্ধন ছিন্ন করে পুরুষের কপালী-ব্রত-গ্রহণ। শুড়ী, ননদ, খালিকা ও মায়ের মায়াবন্ধন কেটে পুরুষ কপালী হয়ে যেত- ‘ঝারিঅ মাসু ননদ ঘরে শালী। | মা মারিয়া কাহ্ন ভইল করালী। চর্যাগানের আরও দু-একটি নমুনা — ‘গঙ্গা জউন। মাঝেঁরে বহই নাই। | তহি বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করই।’

কবি জয়দেব ভগবান বিষ্ণুর সামনে প্রণত
কবি জয়দেব ভগবান বিষ্ণুর সামনে প্রণত

চর্যাগীত সম্বন্ধে ডঃ নীলরতন সেন একজন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত। তিনিও বলেছেন: ‘চর্যাগীতের মধ্যে তখনকার দেশ-কাল-সমাজের নানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। মনে হয় গ্রামীণ কষি-শিক্ষা-বাণিজ্য -ভিত্তিক একটি সমাজ পরিবেশ গীতগুলিতে বেশ ধরা পড়েছে। গ্রামগুলি বেশীর ভাগই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। সেখানে যাতায়াতের মুখ্য বাহন ছিল নৌকা, কাঠের সাঁকোতেও পারাপার চলত। নৌকার হাল-বৈঠা, গলুই, পাল, গুণ, নোঙর করবার খুঁটি, জল ছেঁচবার সেঁউতি প্রভৃতির বিশদ নাম-পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।

কুলীনজনেরা,— অর্থাৎ উঁচুবর্ণের লোকেরা গাঁয়ের কেন্দ্রে বাস করতেন। ডোম, চণ্ডাল—এরা গাঁয়ের প্রান্তে, পাহাড়ি টিলায় বাস করত। পাহাড়ের গায়ে ত্রিতল বাড়ির বর্ণনা রয়েছে। কৃষিকর্ম ছাড়া, নৌকা বাওয়া, তাঁত বোনা, ধুহরির কাজ, ডালা-কুলো তৈরী, হরিণ শিকার, কাঠুরিয়ার ও ছুতোরের কাজ, নৌকাপথে সোনা-রূপোর ব্যবসা-বাণিজ্য, — এসবের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। নিম্নশ্রেণীর স্ত্রীলোকদের মধ্যে নৃত্যগীত, মদ চোলাই ও বিক্রয় এমনকি বারাঙ্গনাবৃত্তির প্রচলন ছিল।

সম্রান্ত লোকদের বেশ বিষয়-আশয় থাকত। ঘরে সোনারূপা গয়নাগাঁটি থাকবার ফলে চোর-ডাকাতের উপদ্রবও হত। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারে দুবেলা খাবার জুটত না। যৌথ পরিবার প্রথা প্রচলিত ছিল। স্বামী, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ছাড়া, শ্বশুর, ননদ, শ্যালিকা এক পরিবারে বসবাস করতেন। অল্পবয়সী বধূ তাদের একদিকে ভয় করতেন, অন্যদিকে রাতের আঁধারে অভিসারেও যেতেন। চোর-ডাকাত ছিল বলেই গৃহস্থকে তালাচাবির ব্যবহার শিখতে হয়েছিল। গৃহস্থেরা যেসব তৈজসপত্র ব্যবহার করতেন তার কিছু কিছু নাম পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, ভাতের হাঁড়ি, দুধ দুইবার পীটা, জল আনবার (বা মদ রাখবার ) ঘড়া, ঘড়ী, আরও ক্ষদ্র মাপের ঘণ্ডুলি।

কাঠুরেদের কুঠার, টাঙ্গী, কৃষকদের নখলি (মাটি খুঁড়বার থোস্তা) ইত্যাদি। মেয়েরা গয়না পরতেন নৃপুর, কাঁকন, মুক্তার হার, কুণ্ডল, কানেট ( কর্ণাভরণ ) ইত্যাদি। প্রসাধনে সুন্দরীদের দর্পণ প্রয়োজন হত। কর্পূর-সুবাসিত পান খাবার বিলাসিতা ছিল। খাটে পরিপাটি বিছানা পেতে ওরা শয়ন করতেন। গোঁড়া সনাতনী হিন্দুরা আগম, বেদ, শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করতেন, কোশাকুশি নিয়ে পূজা করতেন। ইষ্টমালা জপ করতেন। দীর্ঘজীবন লাভের জন্য রস-রসায়নের ব্যবহার করা হত। এসব নিয়ে বৌদ্ধরা হিন্দুদের বিদ্রূপ করেছেন।

কাপালিকদের মধ্যে তন্ত্রসাধনের নানা কামাচারও চলত। কৃষ্ণা চার্যের একটি গীতে বিয়ের যে ছবি দেওয়া হয়েছে তাতে বেশ ধুমধাম হত মনে হচ্ছে। নানা বাদ্য বাজিয়ে, শোভাযাত্রা করে বর বিয়েতে চলেছেন। বিয়েতে যৌতুকও দেওয়া হত। নাচ-গানে করও, কনালা, লাউয়ের একতারা, মাদল, দুন্দুভি, বীণা—এসবের ব্যবহার হত। কৃষ্ণাচার্য ‘নয়বল’ নামে দাবাখেলার ছবি দিয়েছেন। কুঁড়েঘর এবং ‘তইলা বাড়ি’ (ত্রিতল গৃহ) দুয়েরই উল্লেখ থেকে সেকালের আর্থিক শ্রেণী-বৈষম্যের চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। ধনী ব্যক্তিরা বোধ হয়। শখ করে হাতি পুষতেন।

গৃহপালিত পশুর মধ্যে গাই-বলদের নাম মিলছে। বন্য পশুপাখির মধ্যে সিংহ, হাতি, হরিণ, শিয়াল, খরগোশ, ইদুর, সাপ, কাক, ময়ূর, কুমীর এদের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। ইদুর ধান নষ্ট করত। ফল-ফুলের নাম কম ব্যবহৃত হয়েছে। পদ্ম বা কমল বিশেষ পারিভাষিক অর্থে এসেছে; কাপাস ফুলের উল্লেখ দেখছি একটা গীতে। ‘কঙ্গুচিনা’ ফল ঠিক কি বস্তু বলা যাচ্ছে না। তবে শবর-শবরী এ ফল পাকলে আনন্দে মেতে উঠত। বোধ করি কোনো নেশা ধরানো প্রিয় খাদ্য ছিল।

উঁচু সমাজে নারীদের সতীত্বকে গুরুত্ব দেওয়া হত, পুরুষরা কিছুটা চারিত্রিক শৈথিল্য দেখাতেন মনে হয়। ‘নগর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রামের সঙ্গে পার্থক্য ছিল কিনা বলা যাচ্ছে না। মদ্য পান চলত। শু*ড়ি মেয়েরা গাছের ছালের সাহায্যে চোলাই করে মদ বেচতেন। কৃষ্ণাচার্য একটি গীতে ( ১৮ নং) ‘কুলীনজনের’ উল্লেখ করেছেন। চর্যাগীতে বঙ্গাল, বঙ্গালী, বঙ্গ —শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে। ভুসুকু বঙ্গদেশের চণ্ডালীকে বিয়ে করে বঙ্গালী হলেন। তাতে আত্মীয়েরা তাকে সম্পত্তি থেকে বোধ হয় বঞ্চিত করেছিল, ৪৯ নং গীতে তার আভাস আছে। বঙ্গাল রাগ একাধিক গীতে ব্যবহৃত হয়েছে। চর্যাগীতে নদী হিসাবে গঙ্গা, যমুনার নাম করা হয়েছে। পদ্মাকে খাল বলা হয়েছে।

চর্যাগানগুলি থেকে আমরা তৎকালীন বাঙলার আর্থিক জীবনেরও একটা ছবি পাই। নৌকার ব্যাপক প্রসঙ্গ প্রমাণ করে যে তখন নৌবাণিজ্যের প্রসার ছিল। বণিকবৃত্তিও প্রচলিত ছিল। নৌকা শুধু নদী পারাপার করত না, সোনার ভরা নিয়ে সীমাহীন নদীপথে যাত্রা করত। নৌকার ব্যাপক প্রসঙ্গ থেকে আমরা আরও বুঝতে পারি যে সূত্রধর, কর্মকার প্রভৃতি বৃত্তির বেশ ব্যাপক প্রচলন ছিল।

আরও পড়ুন:

বাঙালীর জীবনচর্যার বিবর্তন

Leave a Comment