বাঙালীর সমাজ ও জাতিবিন্যাসের বিবর্তন | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর

বাঙালীর সমাজ ও জাতিবিন্যাসের বিবর্তন – ড: অতুল সুর : আর্যসমাজ থেকে বাঙলার সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চাতুবর্ণের ওপর। সুতরাং বিদেহর পূর্বে অবস্থিত ‘প্রাচ্য’ দেশে চাতুবর্ণ-সমাজের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। সেখানে যে সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেটা হচ্ছে কৌমসমাজ – বিভিন্ন বৃত্তিধারী জাতিগোষ্ঠীর সমাজ। সে সমাজের মধ্যে ছিল নানাবৃত্তিধারী মানুষ। কিন্তু তাদের মধ্যে চাতুবর্ণের বিভেদ না থাকার দরুনই আর্যরা প্রাচ্যদেশের লোকদের ঘৃণার চোখে দেখত।

বাঙালীর সমাজ ও জাতিবিন্যাসের বিবর্তন - ড: অতুল সুর

 

প্রাক্-আর্যদের প্রতি বৈদিক আর্যদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব খুব বেশি দিন টেকেনি। পঞ্চনদের উপত্যকা থেকে আর্যরা যতই পূর্বদিকে অগ্রসর হতে লাগল, প্রাক্-আর্যজাতিসমূহের সঙ্গে তাদের ততই সংমিশ্রণ ঘটতে লাগল। এই সংমিশ্রণ বিবাহের মাধ্যমে ঘটেছিল। ( লেখকের ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ ও ‘ডিনামিকস্ অভ্, সিনথেসিস্ ইন হিন্দু কালচার’ দ্রষ্টব্য)। ক্রমশ আর্যরা প্রাক-মার্যজাতিসমূহের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহার অনেক গ্রহণ করতে লাগল।

[ বাঙালীর সমাজ ও জাতিবিন্যাসের বিবর্তন – ড: অতুল সুর ]

‘হুত্র’ যুগেই এই সংমিশ্রণ ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান পূর্ণ-মাত্রায় ঘটেছিল । প্রাচ্যদেশের লোকদের প্রতি তাদের একটা উদার মনোভাব এ যুগেই সঞ্চারিত হয়েছিল এবং তারা বিধান দিয়েছিল যে, যদি কেউ তীর্থ যাত্রা বা অন্য কোনও কারণে প্রাচ্যদেশে যায়, তবে তাদের সে দোষ স্খলিত হবে পুলোষ্টম বা সর্বপৃষ্ট। নামক যজ্ঞদ্বারা। কিন্তু পরে এই শুদ্ধিকরণ-বিধানেরও ক্রমশ অবলুপ্তি ঘটে।

গঙ্গারিডি
গঙ্গারিডি

দুই

আগেই বলা হয়েছে যে বাঙলার সামাজিক সংগঠন কৌমভিত্তিক ছিল। বাঙলার জনপদগুলি এই সকল কৌমজাতির নামেই অভিহিত হত। এই সকল কৌমজাতির অন্যতম ছিল পুও, বঙ্গ, কর্বট প্রভৃতি। মনে হয়, এই পুওেেদর বংশধররাই হচ্ছে বর্তমান পোদ জাতি। অনুরূপভাবে এটাও অনুমেয় যে, বর্তমান কৈবর্ত্তজাতি কর্বট-কৌমের বংশধর। এইসব জাতি ছাড়া প্রাচীন বাঙলায় আর

এক জাতি ছিল। তারা হচ্ছে বাগ্‌দি জাতি। এছাড়া আরও ছিল—হাড়ি, ডোম, বাউড়ি প্রভৃতি জাতির পূর্বপুরুষরা। প্রাচীন গ্রীক লেখকদের রচনাবলী থেকে আমরা জানতে পারি যে, মৌর্যদের সময় পর্যন্ত বাগ্‌দিরাই রাঢ়দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জাতি ছিল। কৈবর্তদের উল্লেখ মনুর ‘মানবধর্মশাস্ত্র’-এ আছে। মহু এদের বর্ণ-সঙ্কর বলে অভিহিত করেছেন। বিষ্ণুপুরাণ-এ এদের ‘অব্রাহ্মণ্য’ বলা হয়েছে। মনে হয়, মনু অপেক্ষা বিষ্ণুপুরাণ-এর উক্তিই ঠিক। দেশের অতি প্রাচীন অধিবাসী হিসাবে কৈবর্তদের সংস্কৃতি যে আর্যদের ব্রাহ্মণ্যধর্মবিহিত সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

পরবর্তী কালে পালরাজাদের সময় কৈবর্ত জাতির শক্তির প্রবল অভ্যুত্থান ঘটেছিল। পালরাজাদের অধীনস্থ এক কৈবর্ত সামন্তরাজ দিব্যোক তাঁর প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাল রাজ দ্বিতীয় মহীপালকে (১০৭০-৭১ খ্রীস্টাব্দ) নিহত করে বরেন্দ্রভূম অধিকার করেন এবং তথায় কিছুকাল রাজত্বও করেন। দিব্যোকের উত্তরাধিকারী হিসাবে আরও দু’জন কৈবর্তরাজা বরেন্দ্রদেশ শাসন করেছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন দোক ও ভীম।

এই সময় কৈবর্তরা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ও সমাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করত। তখন আর তারা ‘অব্রাহ্মণ্য বা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বাইরে ছিল না। বস্তুত তাদের মধ্যে অনেকেই তখন ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল এবং সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করে কবিতা রচনা করতে শুরু করে দিয়েছিল। জনৈক কৈবর্ত কবি পপিপ-কর্তৃক রচিত একটি গঙ্গাস্তোত্র ‘সছক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে।

আর এক জাতি যারা এই সময় প্রাধান্য লাভ করেছিল, তারা হচ্ছে বর্তমান সদ্গোপ জাতির পূর্বপুরুষরা। তাম্রাশ্মযুগ থেকেই গ্রামের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। মনে হয় দক্ষিণরাঢ়ে কৈবর্তদের যেমন আধিপত্য ছিল, উত্তরবাঢ়ে তেমনই সগোপদের প্রাধান্য ছিল। বর্তমানকালে এই দুই জাতির পারস্পরিক অবস্থান থেকে তাই মনে হয়। এরূপ অনুমান কর বার সপক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে যে, পাল ও শুরবংশীয় রাজারা সগোপ ছিলেন।

আরও মনে হয় বাঙলায় তন্ত্রধর্মের ব্যাপক প্রচার তাঁদের চেষ্টাতেই হয়েছিল। বস্তুত তাঁরা শিব ও শক্তির উপাসক ছিলেন। বর্ধমান ও বীরভূমের অংশবিশেষ নিয়েই ছিল সদ্গোপদের বাসস্থান—যাকে ‘গোপভূম’ বলা হত। সদ্গোপদের বিভিন্ন শাখা ভালকী, অমরাগড়, কাঁকশা, দিগ্‌গ্লগর, ঢেক্করী, মঙ্গলকোট, নীল পুর প্রভৃতি স্থানে বহু সদ্গোপ রাজ্য স্থাপন করেছিল। পালরাজাদের আধি পত্যের সময় তারা পালরাজাদেরই সামন্তরাজা হিসাবে রাজত্ব করত।

এই সকল সদেগাপরাজাদের অন্যতম ছিল ইছাই ঘোষ বা ঈশ্বর ঘোষ। খ্রীষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি পালরাজ মহীপালের (১৭৭ ১০২৭ খ্রীস্টাব্দ) সমসাময়িক ছিলেন। রামগঞ্জের তাম্রশাসনে ইছাই ঘোষের বংশ তালিকা দেওয়া হয়েছে। তা থেকে আমরা জানতে পারি যে মহামাগুলিক ইছাই (ঈশ্বর) ঘোষের পিতা ছিলেন ধবলঘোষ (ধর্মমঙ্গল কাব্য অনুযায়ী সোমঘোষ ) ও তাঁর পিতামহ ছিলেন বলঘোষ ও প্রপিতামহ ছিলেন ধূর্তঘোষ।

এ থেকে মনে হয় ধূর্তঘোষ খুব সম্ভবত পালরাজ রাজ্যপাল বা দ্বিতীয় গোপালের সমসাময়িক ছিলেন। অমরাগড়ে ইছাই ঘো সমসাময়িক সগোপরাজ ছিলেন হরিশ্চন্দ্র। ইছাই ঘোষ ছিলেন ধর্মঠাকুরের উপাসক আর হরিশ্চন্দ্র ছিলেন ভবানীর উপাসক। এখানে একথা উল্লেখযোগ্য যে, রামগঞ্জের তাম্র শাসনে ইছাই ঘোষের নামের সঙ্গে যে-সকল উপাধিসূচক বিশেষণ প্রয়োগ করা হয়েছে, তা পালরাজগণ কর্তৃক ব্যবহৃত উপাধিসমূহকেও হার মানিয়ে দেয়।

সগে।পদের প্রাধান্য যেমন উত্তরবাঢ়ে, তেমনই বাঁকুড়া জেলায় ছিল মল্লদের প্রাধান্য। এঁরা প্রাচীন জৈনধর্মাবলম্বীদের উত্তরপুরুষ কিনা তা বিবেচ্য। কেননা, মহাবীর ‘মলভার’ বহন করতেন এবং অনেক জৈন যতি গৌরবের সঙ্গে ‘মলধারী’ উপাধি ধারণ করতেন। পরবর্তীকালে অবশ্য ‘মল্ল’ শব্দটি ‘বীর’ শব্দের সমবাচক শব্দ হিসাবেই গণ্য হত। সে যাই হোক, পরবর্তীকালে আমরা আদিমল্ল, জয়মগ্ন, কালুমল্ল ও বীর হাম্বীর প্রভৃতি মল্লরাজগণের সাক্ষাৎ পাই।

যদিও বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে তাদের রাজধানী অবস্থিত ছিল, তথাপি তাঁদের রাজশক্তি উত্তরে সাঁওতাল পরগনার দামিন-ই-কো থেকে দক্ষিণে মেদিনীপুর জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্ধমানের অংশবিশেষ ও পশ্চিমে পঞ্চকোট, মানভূম ও ছোটনাগপুরের অংশবিশেষ ও তাঁদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে উল্লেখ নীয় যে ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ ‘মা’দের অন্ত্যজ জাতি বলে অভিহিত করা হয়েছে।

মানকালীর ঢিবি
মানকালীর ঢিবি

তিন

যদিও খ্রীস্টপূর্ব যুগ থেকেই বাঙলাদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, তবুও গুপ্তযুগের পূর্বে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বাঙলাদেশে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি।

বস্তুত গুপ্তযুগেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্রাহ্মণরা এসে বাঙলাদেশে বসবাস শুরু করেছিল। সমসাময়িক তাম্রপট্রসমূহ থেকে আমরা জানতে পারি যে, এ সময় বাঙলায় চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য বহু ব্রাহ্মণকে ভূমি দান করা হয়েছিল এবং মন্দির নির্মাণ করাও হয়েছিল। এই সকল লিপি থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, এই সকল ব্রাহ্মণ বেদের বিভিন্ন শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং বৈদিক যজ্ঞ ও ক্রিয়াকলাপাদি সম্পন্ন করা সম্বন্ধে তাদের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল।

সাধারণত এই সকল ব্রাহ্মণ ‘শর্মা’ ও ‘স্বামিন’ উপাধি ধারণ করত। ব্রাহ্মণদের মধ্যে ‘গাই’ প্রথারও প্রচলন ছিল। ‘গাঁই’ বলতে সেই গ্রামকে বোঝাত যে গ্রামে এসে তারা প্রথম বসবাস শুরু করেছিল। এই সকল ‘গাই’ এর নাম ( যেমন ভট্ট, চট্ট, বন্দ্যো ইত্যাদি) পরবর্তীকালে উপাধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

এই সকল তাম্রপট্টলিপি থেকে আমরা ব্রাহ্মণেতর জাতিসমূহের যে-সকল উপাধি পাই সেগুলি হচ্ছে দত্ত, পাল, মিত্র, বর্মণ, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুও, পালিত, নাগ, চন্দ্র, দাম, ভৃতি, বিষ্ণু, যশ, শিব, রুদ্র ইত্যাদি। এই সকল উপাধি বর্তমানকালে কায়স্থ ও অন্যান্য জাতিসমূহ নিজেদের পদবী হিসাবে ব্যবহার করে। কিন্তু আমরা যে যুগের কথা বলছি সে যুগে স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে ‘কায়স্থ’ জাতির উদ্ভব হয়নি। পরবর্তী কালের তাম্রপট্টসমূহে অবশ্য আমরা এক শ্রেণীর রাজকীয় কর্মচারীর উল্লেখ পাই, যাদের নামের সঙ্গে ‘প্রথম-কায়স্ব’, ‘জ্যেষ্ঠকায়স্থ’, ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে।

কিন্তু তারা সাধারণত সচিবালয়ে লেখকের কাজ করত। সমার্থবোধক শব্দহিসাবে ‘করণ’ শব্দও ব্যবহৃত হতে দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রন্থসমূহ থেকেও আমরা জানতে পারি যে, প্রথমে ‘কায়স্থ’ এক বিশেষ বৃত্তিধারী গোষ্ঠীর নাম ছিল, কোনও বিশেষ জাতির নাম নয়। ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এর জাতির তালিকার মধ্যে ‘কায়স্থ’ শব্দের পরিবর্তে সমার্থবোধক ‘করণ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। চান্দেল্লরাজ ভোজ বর্মণের অজয়গড়-লিপিতেও তাই করা হয়েছে। গাহড়বালরাজ গোবিন্দচন্দ্রের লিপিসমূহেও তাই।

সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার এই যে যদিও ওই সময়ের লিপিসমূহে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যান্য অনেকেরই নামের উল্লেখ আছে, কিন্তু তারা কেউই নিজেদের ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য বলে দাবি করেনি। বিশেষ করে আমরা প্রচুর পরিমাণে

বাঙালীর সমাজ ও জাতিবিশ্বাসের বিবর্তন ‘নগরশ্রেষ্ঠী’, ‘দার্থবাহ’, ‘ব্যাপারী’ প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ পাই। কিন্তু তাদের কাউকেই আমরা ‘বৈশ্য’ বলে দাবি করতে দেখি না। মনে হয়, উত্তরভারতের ন্যায় বর্ণবাচক জাতি হিসাবে ‘ক্ষত্রিয়’ ও ‘বৈ’ জাতি কোনও দিনই বাঙলাদেশে ছিল না, যদিও বর্তমানে অনেক জাতির ক্ষেত্রে ‘ক্ষত্রিয়ত্ব’ দাবি করা একটা নেশায় পরিণত হয়েছে।

উপরে যে সমাজের চিত্র দেওয়া হল, তা হচ্ছে গুপ্তযুগের সমাজের চিত্র। আগেই বলা হয়েছে যে এই যুগেই উত্তরভারত থেকে ব্রাহ্মণরা দলে দলে বাঙলাদেশে এসে বসবাস শুরু করে ও সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করে। পরবর্তী কালে এরাই ‘সপ্তশতী’ বা ‘সাতশতী’ ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হয়। রাঢ়দেশে তারা সাতটি গোত্রভুক্ত ছিল ও বরেন্দ্রদেশে পাঁচটি। কুলশাস্ত্রসমূহে তাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠাহীনতা ও অজ্ঞতার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা অভিসন্ধিমূলক কু-প্রচার বলে মনে হয়।

এটা পালযুগের ভূমিদান-সংক্রান্ত তাম্রপট্টলিপিসমূহ থেকে প্রমাণিত হয়। কেননা, গুপ্তযুগে সাধারণ ব্যক্তিরাই ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করত। কিন্তু পালযুগে রাজারাজড়ারাও ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতে শুরু করেন। এই সকল তাম্রপট্টলিপিসমূহে ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রজ্ঞ ও যাগযজ্ঞাদিকর্মে বিশেষ পার দর্শী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সকল ব্রাহ্মণ যে ‘সপ্তশতী’ সমাজভুক্ত ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

এই সকল লিপি থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, বাঙলাদেশে ব্রাহ্মণ ব্যতীত চাতুর্বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তার মানে গুপ্তযুগের ন্যায় পালযুগেও অনুরূপ সমাজব্যবস্থাই ছিল। মোট কথা, ওই যুগের ব্রাহ্মণেতর সমাজে পরবর্তী কালের ন্যায় কোনরূপ জাতিভেদ ছিল না। কায়স্থরা পেশাদারী শ্রেণী হিসাবেই গণ্য হত এবং তারা রাজাদের মন্ত্রী ও এমন কি ভিষক্ হিসাবেও নিযুক্ত হত।

এরূপ একজন ভিষক্-কায়স্থ ‘শব্দপ্রদীপ’ নামে একখানি ভেষজ-সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বস্তুত নবম ও দশম শতাব্দী থেকেই কায়স্থরা নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে গণ্য করতে শুরু করেছিল। এবং তখনই বোধ হয় অন্যান্য জাতিসমূহের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে কৈবর্তদের তো অভ্যুত্থান ঘটেই ছিল, কারণ তা দিব্যোকের বিদ্রোহ থেকেই প্রকাশ পায়। কিন্তু অন্য কোনও ব্রাহ্মণেতর জাতির উল্লেখ পালযুগের অনুশাসনসমূহে বড় একটা পাওয়া যায় না। এই সকল অনুশাসনে প্রধান ও অপ্রধান রাজকর্মচারীদের নামের তালিকার পর যাদের উল্লেখ পাওয়া যায়, তারা হচ্ছে ‘প্রতিবেশী’, ‘ক্ষেত্রকার’ (বা ‘ভূমিকর্ষক’ এবং ‘কুটুম্ব’ বা প্রধান প্রধান গৃহস্থ।

সুতরাং বাঙলাদেশে বর্তমানে যে জাতিবিন্যাস দেখতে পাওয়া যায়, পাল যুগে তার সম্পূর্ণ অভাব পরিলক্ষিত হয়। সমাজের নিম্নকোটির অন্তর্ভুক্ত যাদের নাম এই সকল অনুশাসন থেকে পাওয়া যায়, তাদের অন্যতম হচ্ছে মেদ, অনস্ত্র ও চণ্ডাল। কিন্তু চর্যাসাহিত্যে আমরা যে-সকল জাতির উল্লেখ পাই তারা হচ্ছে ডোম, চণ্ডাল, শবর ও কাপালিক। এরা সকলেই নিম্নস্তরের লোক ছিল। ডোমেরা গ্রাম বা নগরের বাইরে বাস করত ও ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক অস্পৃরূপে গণ্য হত।

বৃত্তি হিসাবে তারা ঝুড়ি-চুপড়ি ইত্যাদি তৈরি করত এবং নাচ-গানে তারা বিশেষ পারদর্শী ছিল। সকলের নীচে স্থান ছিল কাপালিকদের। তারা নর-কঙ্কালের মালা পরে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াত। শবররা পর্বতে ও অরণো বাস করত। তারা ময়ুরপুচ্ছের পরিচ্ছদ পরত এবং গলায় গুঞ্জাবীজের মালা ও কানে বজ্রকুগুল ধারণ করত। তারা সঙ্গীতেও পারদর্শী ছিল এবং তাদের দ্বারা ‘শবরী’ রাগের প্রবর্তন হয়েছিল।

চার

এখন দেখা যাক, বাঙলার সমাজবিন্যাসের ইতিহাসে সেনযুগে কি ঘটেছিল। পালরাজারা বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু সেনরাজারা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের শুভস্বরূপ। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাঁরা যথেষ্ট প্রয়াসী হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্ভুক্ত পূজা-অৰ্চনাদি ও যাগযজ্ঞ-সম্পাদনে তাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন। এই সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য পুনরায় ঘটে। তাঁরা স্মৃতিশাস্ত্র অনুশাসন অনুযায়ী বিধান দিতে থাকেন এবং এই সকল বিধান সমাজকে ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে।

এই যুগেই রাঢ়ী ও বারেন্দ্র ছাড়া, বৈদিক, শাকদ্বীপি প্রভৃতি ব্রাহ্মণ দের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে। নানা শ্রেণীর ব্রাহ্মণের ছড়াছড়ি ঘটায় এই যুগে নূতন করে ব্রাহ্মণসমাজ সংগঠিত হয় এবং কিংবদন্তী অনুযায়ী সেনরাজা বল্লালসেন কৌলীন্য-প্রথা প্রবর্তন করেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে গাঁই-এর প্রাধান্য এই যুগে পরিলক্ষিত হয় এবং বন্দ্যো, চট্ট, মুখটী, ঘোষাল, পুতিত্বও, গাঙ্গুলী, কাঞ্জীলাল ও কুন্দলাল প্রধান বা ‘মুখ্যকুলীন’ হিসাবে পরিগণিত হয়। আর রায়ী, গুড়, মাহিস্ত, কুলভী, চৌতখণ্ডি, পিপ্পলাই, গড়গড়ি, ঘণ্টাসরী, কেশরকোনা, দিমসাই, পরিহল, হাড়, পিতমুণ্ডী ও দীর্ঘতি — এরা হয় গৌণ কুলীন।

বাকী ব্রাহ্মণরা শ্রোত্রিয় শ্রেণীভুক্ত হয়। রাঢ়ীয়দের ৫৬টি গাঁই (কাকুর মতে ৫২ বা ৫৯)। আর বারেন্দ্রদের ১০০টি গাঁই। কিন্তু কিংবদন্তি অনুযায়ী বল্লালসেন কর্তৃক মাত্র পাঁচটি বারেন্দ্র গাঁই, যথা—লাহিড়ী, বাগচী, মৈত্র ও ভাদুড়ী কুলীন বলে স্বীকৃত হয়। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণর। তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়, যথা— সিদ্ধশ্রোত্রীয়, সাধ্য-শ্রোত্রীয় ও কাষ্ঠশ্রোত্রীয়।

এখানে পরবর্তী কালে রচিত কুলপঞ্জিকাসমূহে বিবৃত এক কাহিনীর উল্লেখ করা যেতে পারে। এই কাহিনী অনুযায়ী গৌড়ের রাজা আদিশূর একটি যন্ত্র সম্পাদন করবার সংকল্প করে কান্যকুব্জ থেকে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে আনেন। বাঙলাদেশে সাতশতী, বৈদিক প্রভৃতি শ্রেণী ছাড়া আর যত ব্রাহ্মণ বর্তমানে আছে তারা সকলেই এই পঞ্চব্রাহ্মণের বংশধর। এই পঞ্চব্রাহ্মণের সঙ্গে যে পাঁচজন ভৃত্য আসে বর্তমান বাঙলার কহুলীন কায়স্থগণ তাদের মধ্যে চারজনের বংশধর।

কুলগ্রন্থসমূহে আদিশূরকে বল্লালসেনের মাতামহ বলা হয়েছে। কিন্তু পণ্ডিতমহলে আদিশূর-কর্তৃক এই পঞ্চব্রাহ্মণ আনয়নের কাহিনী ঐতিহাসিক সত্য বলে গ্রহণ করা হয়নি। তবে আদিশুর নামে বাঙলাদেশে যে কোনও রাজা ছিলেন না, বা তিনি কোনও যজ্ঞ সম্পাদন করেননি বা তা অলীক বলে মনে করবার সপক্ষেও কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু কুলপঞ্জিকাসমূহে আদিশূরের বংশাবলী ও রাজত্বকাল সম্বন্ধে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী মতও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি যে যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন বিভিন্ন কুলপঞ্জিকায় তার বিভিন্ন নাম এবং তিনি যে পঞ্চব্রাহ্মণ এনেছিলেন বিভিন্ন গ্রন্থে তাদের বিভিন্ন নাম দেখে ওই কাহিনীর যথার্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে।

তবে এটা ঠিক যে সেনরাজা বল্লালসেন কর্তৃক নূতন করে সামাজিক সংগঠনের একটা চেষ্টা হয়েছিল, যদিও সেটার ধারা, প্রকৃতি ও পদ্ধতি সম্বন্ধে আমাদের সঠিক কিছু জানা নেই। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেছেন যে, সেনযুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে বহু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় এবং সামাজিক সংগঠনের মধ্যে তাদের স্থান নির্ণয় করবার প্রয়োজনীয়তা সেনযুগেই অনুভূত হয়। এর ফলে, বাঙলাদেশে নানা জাতি ও উপজাতির সৃষ্টি হয়। সেনরাজত্বের অব্যবহিত পরেই ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ রাঢ়দেশে রচিত হয়েছিল। ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ নানা জাতি ও উপজাতির উল্লেখ আছে।

কেশরকোনা, দিমসাই, পরিহল, হাড়, পিতমুণ্ডী ও দীর্ঘতি — এরা হয় গৌণ কুলীন। বাকী ব্রাহ্মণরা শ্রোত্রিয় শ্রেণীভুক্ত হয়। রাঢ়ীয়দের ৫৬টি গাঁই (কাকুর মতে ৫২ বা ৫৯)। আর বারেন্দ্রদের ১০০টি গাঁই। কিন্তু কিংবদন্তি অনুযায়ী বল্লালসেন কর্তৃক মাত্র পাঁচটি বারেন্দ্র গাঁই, যথা—লাহিড়ী, বাগচী, মৈত্র ও ভাদুড়ী কুলীন বলে স্বীকৃত হয়। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণর। তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়, যথা— সিদ্ধশ্রোত্রীয়, সাধ্য-শ্রোত্রীয় ও কাষ্ঠশ্রোত্রীয়।

এখানে পরবর্তী কালে রচিত কুলপঞ্জিকাসমূহে বিবৃত এক কাহিনীর উল্লেখ করা যেতে পারে। এই কাহিনী অনুযায়ী গৌড়ের রাজা আদিশূর একটি যন্ত্র সম্পাদন করবার সংকল্প করে কান্যকুব্জ থেকে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে আনেন। বাঙলাদেশে সাতশতী, বৈদিক প্রভৃতি শ্রেণী ছাড়া আর যত ব্রাহ্মণ বর্তমানে আছে তারা সকলেই এই পঞ্চব্রাহ্মণের বংশধর। এই পঞ্চব্রাহ্মণের সঙ্গে যে পাঁচজন ভৃত্য আসে বর্তমান বাঙলার কহুলীন কায়স্থগণ তাদের মধ্যে চারজনের বংশধর।

কুলগ্রন্থসমূহে আদিশূরকে বল্লালসেনের মাতামহ বলা হয়েছে। কিন্তু পণ্ডিতমহলে আদিশূর-কর্তৃক এই পঞ্চব্রাহ্মণ আনয়নের কাহিনী ঐতিহাসিক সত্য বলে গ্রহণ করা হয়নি। তবে আদিশুর নামে বাঙলাদেশে যে কোনও রাজা ছিলেন না, বা তিনি কোনও যজ্ঞ সম্পাদন করেননি বা তা অলীক বলে মনে করবার সপক্ষেও কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু কুলপঞ্জিকাসমূহে আদিশূরের বংশাবলী ও রাজত্বকাল সম্বন্ধে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী মতও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি যে যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন বিভিন্ন কুলপঞ্জিকায় তার বিভিন্ন নাম এবং তিনি যে পঞ্চব্রাহ্মণ এনেছিলেন বিভিন্ন গ্রন্থে তাদের বিভিন্ন নাম দেখে ওই কাহিনীর যথার্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে।

তবে এটা ঠিক যে সেনরাজা বল্লালসেন কর্তৃক নূতন করে সামাজিক সংগঠনের একটা চেষ্টা হয়েছিল, যদিও সেটার ধারা, প্রকৃতি ও পদ্ধতি সম্বন্ধে আমাদের সঠিক কিছু জানা নেই। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেছেন যে, সেনযুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে বহু বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় এবং সামাজিক সংগঠনের মধ্যে তাদের স্থান নির্ণয় করবার প্রয়োজনীয়তা সেনযুগেই অনুভূত হয়। এর ফলে, বাঙলাদেশে নানা জাতি ও উপজাতির সৃষ্টি হয়। সেনরাজত্বের অব্যবহিত পরেই ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ রাঢ়দেশে রচিত হয়েছিল। ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ নানা জাতি ও উপজাতির উল্লেখ আছে।

আরও পড়ুন:

প্রাচীন বাঙলার ধর্মসাধনা – ড: অতুল সুর

Leave a Comment