মঠ মন্দির ও শিল্পপ্রতিভা | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর

মঠ মন্দির, স্তূপ ও বিহার, মূর্তি ও মন্দির-অলংকরণ— এসব নিয়েই বাঙলার স্থাপত্য-ভাস্কর্যের ইতিহাস। বৌধায়ন ধর্মস্বরে আছে যে যদিও বাঙলাদেশ আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তা হলেও তীর্থযাত্রা উপলক্ষে আর্যসমাজের লোকরা বাঙলাদেশে আসত। তীর্থস্থান বললেই আমরা দেবস্থান বুঝি। দেবস্থানের বৈশিষ্ট্য, সেখানে মন্দির বা দেবায়তন থাকা। সুতরাং বাঙলাদেশে প্রাক্-আর্য-কাল থেকেই যে মন্দির বা দেবায়তন ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তারপর ভগবান বুদ্ধের তিরোভাবের পর তাঁর প্রবর্তিত ধর্মের অনুগামীরা বহু চৈত্য, স্তূপ ও বিহার নির্মাণ করেছিল। স্তূপগুলি ভগবানের উপস্থিতির প্রতীকরূপে শ্রদ্ধা ও ভক্তি পেত।

মঠ-মন্দির ও শিল্পপ্রতিভা | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর - গৌতম বুদ্ধ [ Buddha in Sarnath Museum, Dhammajak Mutra ]
গৌতম বুদ্ধ [ Buddha in Sarnath Museum, Dhammajak Mutra ]
বৌদ্ধ সাহিত্যে উল্লিখিত আছে যে সম্রাট অশোক তাঁর সমগ্র সাম্রাজ্যে আশী হাজার স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। এবং যেহেতু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় থেকেই বাঙলা মৌর্যসাম্রাজ্যভুক্ত ছিল সেহেতু আমরা অনুমান করতে পারি যে তিনি বাঙলাদেশেও এরূপ বহু স্তূপ নির্মাণ করিয়ে ছিলেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মণি নদীর পূর্ব নাম লালুয়া গাঙ ) উত্তরে দুটি মঠবাড়ি, প্রাচীন দুর্গের দেওয়াল, বাঁধানো পথ, শিলালিপি, স্বর্ণমুদ্রা, বুদ্ধমূর্তি ও অন্যান্য প্রত্নদ্রব্য মৌর্য-উত্তর যুগের এক সুমহান সভ্যতার নিদর্শন অনাবৃত করেছে। খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রারম্ভে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন, সপ্তম শতাব্দীতে উয়াং চুয়াঙ (৬৪৪ খ্রীস্টাব্দ) ও ই-চিৎ (৬৭৩ খ্রীস্টাব্দ) বাঙল। দেশে বহু স্তূপ ও বিহার দেখেছিলেন। তার পূর্ববর্তী কয়েক শতাব্দী বাঙলাদেশ গুপ্তসম্রাটগণের অধীন ছিল। গুপ্ত সম্রাটগণ ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রসারে বিশেষ প্রয়াসী ছিলেন। সুতরাং তাঁদের আমলে বাঙলাদেশে যে বহু হিন্দুর দেবমন্দির নির্মিত হয়েছিল, তা সহজেই অনুমেয়।

[ মঠ মন্দির ও শিল্পপ্রতিভা | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর ]

অনুরূপভাবে সেনরাজগণের আমলেও হিন্দুর বহু দেব-দেউল নির্মিত হয়েছিল। সম্প্রতি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বামুনপুকুর গ্রামে বল্লালঢিবি নামে সেন-যুগের এক বিরাট ‘পঞ্চরথ’ মন্দির ‘কমপ্লেকস্’-এর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তার আগে পালরাজগণের চারশত বৎসরব্যাপী শাসনকালে বৌদ্ধধর্ম বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল, রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহু স্তূপ ও বিহার নির্মিত হয়েছিল।

কিন্তু বাঙলার মঠ-মন্দির ও স্তূপ-বিহারের এরূপ সুমহান ইতিহাস থাকলেও এর নিদর্শন খুব বিরল। প্রায় সবই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কারণ, বাঙলা যখন ১২০৪ খ্রীস্টাব্দের পর মুসলমান অধিকারে যায়, তারা ধর্মদ্বেষের বশীভূত হয়ে এদেশের দেব-দেউল সবই বিনষ্ট করেছিল। ওই সব বিনষ্ট দেব-দেউলের উপাদান দিয়ে তারা মসজিদ নির্মাণ করেছিল। মুসল মান আমলে নির্মিত বহু মসজিদ এর সাক্ষ্য বহন করছে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলিতে সিদ্ধার্থের মহাভিনিষ্ক্রমণ [ Departure of Siddhartha ]
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুলিতে সিদ্ধার্থের মহাভিনিষ্ক্রমণ [ Departure of Siddhartha ]
বড় স্তূপগুলি বিনষ্ট হলেও মুসলমানদের ধর্মদ্বেষের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে, ক্ষুদ্রকায় স্তূপগুলি। দরিদ্র ভক্তগণ যারা দেবতার নিকট ‘মানত’ করত যে তাদের বিশেষ প্রার্থনা বা অভিলাষ পূর্ণ হলে তারা স্তূপ নির্মাণ করে দেবে, অথচ সঙ্গতিতে কুলাত না বড় স্তূপ নির্মাণ করিয়ে দেবার, তারাই এরূপ ক্ষুদ্রকায় স্তূপ নির্মাণ করে ঠাকুরের কাছে উৎসর্গ করত। এরূপ ক্ষুদ্রকায় স্তূপের বোধ হয় সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হচ্ছে ঢাকা জেলার আসরফপুর গ্রামে রাজা দেব খড়্গের তাম্রশাসনের সঙ্গে যে ব্রোঞ্জ বা অষ্টধাতুনির্মিত স্তূপটি পাওয়া গিয়েছে ।

পাহাড়পুরে ও চট্টগ্রামের অন্তর্গত ঝেওয়ারিতেও সেরূপ ধাতুনির্মিত স্তূপ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া পাহাড়পুর ও বাঁকুড়ার বহুলাড়াতেও ইষ্টক নির্মিত বহু স্তূপের অধোভাগ আবিষ্কৃত হয়েছে। যোগী-গুম্ফা নামক স্থানে এরূপ পাথরের তৈরী ক্ষুদ্রকায় স্তূপ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু বৃহদাকার কোন স্তূপের নিদর্শন আমরা পাইনি। তবে বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে আমরা বরেন্দ্রের মৃগস্থাপন স্তূপের ও তুলাক্ষেত্রে বর্ধমান স্তূপ-এর চিত্র পাই ।

বিহারগুলি বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের বাসস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হত। চৈনিক পরি ব্রাজকদের কাহিনী থেকে আমরা বাঙলাদেশের বহু বিহারের সংবাদ পাই। তবে সেসব বিহারের অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যেগুলি পাওয়া গিয়েছে সেগুলি থেকেই আমরা ওইসব বিহারের আকার-প্রকার সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারি। এরূপ এক বিশালকায় বিহারের ধ্বংসাবশেষ পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত হয়েছে।

খুব সম্ভবত পালসম্রাট ধর্মপাল অষ্টম শতাব্দীতে ‘সোমপুর বিহার’ নামে যে বিখ্যাত বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন এটি তারই ধ্বংসাবশেষ, যদিও এক তাম্রশাসন থেকে আমরা জানতে পারি যে খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে এখানে এক জৈন বিহার ছিল। পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত এই বিরাট বিহারের অঙ্গনটি প্রতি দিকে ৬০০ হাত দীর্ঘ ছিল। এতে ১৩ ফুট করে দীর্ঘ ১৭৭টি কক্ষ ছিল। অঙ্গনটির মাঝখানে এক প্রকাও মন্দির ছিল। ভারতে আজ পর্যন্ত যত বিহারের ধ্বংসা বশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে সোমপুর বিহারই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ।

সোমপুর মহাবিহার [ Paharpur Buddhist Bihar ]
সোমপুর মহাবিহার [ Paharpur Buddhist Bihar ]
কুমিল্লার কাছে ময়নামতী নামে যে ছোট ছোট পাহাড় আছে, তার ওপরে ও কয়েকটি বিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়াছে। মালদহ জেলার জগদ্দলেও একটি মহাবিহার ছিল।

বাঙলার প্রাচীন মন্দির সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান খুবই কম। মাত্র কয়েকটি বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে অঙ্কিত চিত্র ও কতকগুলি প্রস্তরমূর্তিতে উৎকীর্ণ মন্দিরের প্রতিকৃতি থেকেই আমরা প্রাচীন বাঙলার মন্দিরসমূহের গঠনরীতি সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারি। মন্দিরগুলি সাধারণত সেই রীতিতে নির্মিত হত, ওড়িশায় যা ‘ভদ্র’ ও ‘রেখ’ মন্দির নামে অভিহিত হয়। কোন কোন জায়গায় এই সকল মন্দিরের মাথায় একটি করে স্তূপ স্থাপন করে আরও দুই শ্রেণীর মন্দির নির্মাণ করা হত।

আবিষ্কৃত মন্দির খুব কমই পাওয়া গিয়েছে। বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর মন্দিরের অঙ্গনে নন্দীর যে ছোট মন্দিরটি আছে, তা ‘ভদ্র’ রীতিতে গঠিত মন্দিরের একমাত্র নিদর্শন। বর্ধমান জেলার বরাকরে ও বাঁকুড়ার দেহারের মন্দির ‘রেখ’ রীতিতে নির্মিত মন্দিরের নিদর্শন। এই মন্দিরগুলি হয় পাথরের, আর তা নর তো ইটের তৈরী।

ইটের তৈরী মন্দিরের নিদর্শন বর্ধমানের দেউলিয়ার মন্দির, বাঁকুড়ার বহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দির ও সুন্দরবনের জটার দেউল। আর পাথরের তৈরী মন্দিরের নিদর্শন বাঁকুড়ার দেহারের সর্বেশ্বর ও সল্লেশ্বরের মন্দির। পাহাড় পুরের অঙ্গনের মধ্যে যে বিশাল মন্দিরটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার ঊর্ধ্বভাগ বিলুপ্ত হওয়ায় ওটি ঠিক কোন্ শ্রেণীর মন্দির তা বলা কঠিন। বড় বড় মন্দিরের অনুকরণে ছোট ছোট মন্দির ও নির্মিত হত। রাজশাহী জেলার অন্তর্গত নিমদীঘি ও দিনাজপুরের অন্তর্গত বাণগড়ে এরূপ প্রস্তরনির্মিত ও চট্টগ্রামের কেওয়ারিতে ব্রোঞ্জনির্মিত এরূপ ক্ষুদ্রকায় মন্দির পাওয়া গিয়েছে। শেষোক্ত মন্দিরটি বুদ্ধগঙ্গার মন্দিরের অনুকরণে নির্মিত।

গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ [ Death of the Buddha BM ]
গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ [ Death of the Buddha BM ]
এখানে উল্লিখিত বাণগড়ে জনৈক কাম্বোজ রাজার লিপিযুক্ত প্রস্তরস্তম্ভ ও পালরাজ তৃতীয় গোপালের রাজত্বকালের লেখযুক্ত সদা শিবের প্রস্তরনির্মিত মূর্তি এবং পোড়ামাটির গণেশমূর্তিও পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া মৌর্য-শুঙ্গ-কুশান-গুপ্তযুগের ইষ্টক নির্মিত বাস্তগৃহ, দেবমন্দির, দুর্গপ্রাচীর, গৃহপ্রাচীর, শ্যাগার, রক্ষিগৃহ, ভূগর্ভস্থিত সুরঙ্গ, স্নানাগার, কূপ প্রভৃতি পাওয়া গিয়েছে, যা ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের মনোরম নিদর্শন। বাণগড়কে অসুররাজ বলির পুত্র’বাগের রাজধানী বলা হয়। ইহা দেবীকোট ও কোটিবর্ষের সহিত অভিন্ন।

ভাস্কর্যশিল্পের নিদর্শন হিসাবে বাঙলার বহুস্থানে নানা দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। গোড়ার দিকের মুর্তিগুলি অধিকাংশই পোড়ামাটির মুর্তি। মৌর্যযুগের এরূপ পোড়ামাটির মূর্তি পাওয়া গিয়েছে মহাস্থানগড়ে। শুভযুগের যক্ষিণীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে বাঁকুড়ায় চন্দ্রবর্মার রাজধানী পৃষ্করণায় ও মেদিনীপুরের তাম্র লিপ্তিতে। কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড় বা বেড়াচাপায় প্রাপ্ত সূর্যমূর্তি ও মালদহ জেলার হাঁকরাইল গ্রামের বিষ্ণুমূর্তিটি কুশানযুগের বলে অনুমিত হয়েছে।

সুন্দরবনের কাশীপুর ও বগুড়ার দেওয়ায় প্রাপ্ত সূর্যমূর্তি দুটি গুপ্তযুগের শিল্পরীতি অনুযায়ী গঠিত। অনুরূপভাবে গুপ্তযুগের আদর্শে গঠিত মহাস্থানের নিকট বলাইধাপভিটায় প্রাপ্ত সোনার পাতে ঢাকা অষ্টধাতুনির্মিত একটি মঞ্জুশ্রী মূর্তি। তবে মূর্তিগঠনে বাঙালীর নিজস্ব শিল্পরীতির একট। বিবর্তন পাওয়া যায়। এর আভাস আমরা পাই দেবখগের রানী প্রভাবতীর লিপিযুক্ত শর্বাণীর ধাতুনির্মিত এক মূর্তিতে ও তার সঙ্গে প্রাপ্ত এক ক্ষুদ্র সূর্যমূর্তিতে ও চব্বিশ পরগনার মণির হাটে প্রাপ্ত ধাতুনির্মিত এক শিবমূর্তিতে। এ মূর্তিগুলি পালযুগের শিল্পরীতির লক্ষণ সূচনা করে।

খ্রষ্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রবল প্রতাপশালী পালরাজাদের আমলে বাঙলাদেশে ভাস্কর্যের এক নূতন ঘরানা গড়ে উঠেছিল। মূলগতভাবে এই নূতন ঘরানা গুপ্তযুগের সারনাথ-ঘরানা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। উত্তরবাৎসার পাতাড় পুরে আবিষ্কৃত কয়েকটি ভাস্কর্য উভয় যুগের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। যদিও গুপ্তযুগের সারনাথ-ঘরানার সঙ্গে বাঙলা ভাস্কর্যের এই ঘরানা সংযুক্ত ছিল, তথাপি উন্নত অবস্থায় এই ঘরানার এক নিজস্ব স্বকীয়তা ছিল। সেজন্য বাঙলার এই ঘরানাকে ভারতীয় ভাস্কর্যের ‘প্রাচ্যদেশীয় ঘরানা’ বলা হয়। প্রাচ্যদেশীয় ঘরানার ভাস্কর্যগুলি বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য এই উভয় ধর্মের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল।

বাঙলায় বৌদ্ধ ভাস্কর্যের উদ্ভব হয়েছিল তখন, যখন বাঙলাদেশ তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা প্লাবিত হয়েছিল। যে সকল মূর্তি এ যুগের ভাস্করেরা নির্মাণ করেছিলেন, সেসবের বর্ণনা আমরা বৌদ্ধ ‘সাধনমালা’ গ্রন্থসমূহে পাই। বৌদ্ধ পুরুষ-দেবতা মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ছিল নানাশ্রেণীর বোধিসত্ত্ব মূর্তি, যথা— লোকনাথ, মৈত্রেয়ী, মঞ্জুশ্রী প্রভৃতি। বৌদ্ধ দেবী বা শক্তিমূর্তির মধ্যে আমরা দেখি তারা, মারীচি, প্রজ্ঞাপারমিতা প্রভৃতি। এছাড়া, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য— এই উভয় ধর্মেরই অন্তর্ভূক্ত কতকগুলি মূর্তি আমরা পাই, যেমন— কুবের, সরস্বতী ও গণেশ মূর্তি।

Bahulara Ancient Temple - Deu of Bohulara
Bahulara Ancient Temple – Deu of Bohulara

প্রাচ্যদেশীয় ঘরানার ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্ভুক্ত মূর্তিসমূহ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত, যথা— (1) বৈষ্ণব, (২) শৈব ও (৩) বিবিধ। বিষ্ণুমূর্তি বাঙলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া গিয়েছে। এই সকল মূর্তির অধিকাংশই একাদশ শতাব্দীর। তা থেকে বোঝা যায় যে, ওই সময় বিষ্ণুর আরাধনা বাঙলাদেশে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। মূর্তি-সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহে নানা ধরনের বিষ্ণুমূর্তির উল্লেখ আছে, কিন্তু বাঙলাদেশে যে সকল বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া গিয়েছে তার অধিকাংশই বাসুদেব শ্রেণীর। চারিহস্ত-বিশিষ্ট এই সকল মূর্তির দক্ষিণের উপর হস্তে আছে গদা ও নিম্নহস্তে চক্র এবং বামের উপর হস্তে আছে চক্র ও নিম্নহস্তে শখ।

কতকগুলি মূর্তির পৃষ্ঠদেশের পাথরফলকের ওপর অঙ্কিত আছে বিষ্ণুর দশাবতারের দৃশ্য। এ ছাড়া বিষ্ণুর দশাবতার মূর্তি স্বতন্ত্রভাবেও পাওয়া গিয়েছে, বিশেষ করে বরাহ, নরসিংহ ও বামন অবতার মূর্তি। রাজশাহী মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি মূর্তিতে বিষ্ণুকে গরুড়ের উপর আসীন অবস্থায় দেখা যায়। এই মূর্তিটি বিশেষ তাৎপর্য পূর্ণ। কেননা, এর দ্বারা প্রকাশ পায় যে বাঙলার শিল্পীরা মূর্তিগঠন সম্বন্ধে শাস্ত্রীয় বিধান পরিহার করে স্বভাবস্থলভ প্রকাশভঙ্গীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। বাঙলার একশ্রেণীর বৈষ্ণব মূর্তিতে ঐকৃষ্ণের জন্মদৃশ্য দেখানো হয়েছে। এই সকল মূর্তিতে শয্যা পরি এক নারীমূর্তির বুকের কাছে এক শিশুকে দেখানো হয়েছে। এবং শয্যার নিচে নানারূপ অর্ঘ্য, উভয় পার্শ্বে নারীমূর্তি ও পৃষ্ঠফলকে নানা দেবতার মূর্তিও খোদিত হয়েছে।

প্রাচ্যদেশীয় শিল্পে শিবমুর্তি কেবল যে লিঙ্গাকারে দেখানো হয়েছে, তা নয়। শিবের বিরূপাক্ষ, তাণ্ডব, ভৈরব প্রভৃতি রূপও দেখানো হয়েছে। অনুরূপভাবে পাবতীর মূর্তি, দুর্গামহিষমর্দিনী, চণ্ডী ও অধনারীশ্বররূপে নির্মিত হত। এ ছাড়া আর যেসব দেবীমূর্তি আমরা পাই, তার অন্যতম হচ্ছে সপ্তমাতৃকা, বৈষ্ণবী, কার্তিকেয়ানী, মহেশ্বরী, ইন্দ্রাণী, বরদা, চামুণ্ডা ও গণেশ শক্তি।

লুম্বিনী নগরে সিদ্ধার্থের জন্ম [ Birth of buddha peshawar ]
লুম্বিনী নগরে সিদ্ধার্থের জন্ম [ Birth of buddha peshawar ]
কলকাতায় পূরণচাদ নাহারের সংগ্রহশালায় দৃষ্ট এক বিচিত্র শৈব মূর্তির উল্লেখ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় করেছিলেন। মুর্তিটিতে দেখানো হয়েছে এক শায়িত নারীমূর্তির কোলের কাছে এক শিশু এবং শয্যার মাথার দিকে একটি শিবলিঙ্গ। মনে হয়, এখানে শিল্পী ব্রহ্মপুরাণে বর্ণিত এক উপাখ্যান প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছেন। এই উপাখ্যান অনুযায়ী উমা তাঁর স্বামীকে চিনতে পারেন কিনা তা পরীক্ষা করবার জন্য শিব শিশুরূপে উমার শয্যা পরি তাঁর কোলের কাছে শায়িত হয়েছিলেন, কিন্তু উমা তাঁকে দেখামাত্রই চিনতে পেরেছিলেন।

ব্রাহ্মণ্যধর্ম-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যে সকল মূর্তি বাঙলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পে পরি লক্ষিত হয়, তার মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে সূর্য, গণেশ, ব্রহ্মা, গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী ও মনসা মূর্তি।

আরও পড়ুন:

বাঙলার মনীষা ও সাহিত্যসাধনা | বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন | ড. অতুল সুর

Leave a Comment